নারীর পদচিহ্নে সভ্যতার জাগরণ: ইরান, চীন, মিশর ও ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মানবসভ্যতার নানা উত্থান–পতনের ইতিহাসে নারী ছিল বহু সময়েই অবহেলা, বৈষম্য ও শোষণের শিকার। ভারত, চীন, মিশর ও ইরানের প্রাচীন সভ্যতায় নারীর অবস্থান ছিল এমন এক বাস্তবতা, যেখানে নারীকে স্বাধীন মানুষ হিসেবে নয়—বরং এক অধিকারবিহীন, নির্ভরশীল এবং পুরুষ-নির্ধারিত জীবনের অংশ হিসেবে দেখা হতো। “তাফসির আল-মিজান”-এর ব্যাখ্যায় আল্লামা তাবাতাবাই (রহ.) দেখিয়েছেন—ইসলামপূর্ব বহু জাতির কাছে নারী না পূর্ণ মানুষ ছিল, না পশু—বরং দুটোর মাঝামাঝি একটি সত্তা।
তাফসির আল-মিজান–এর দ্বিতীয় খণ্ডে (আয়াত ২২৮–২৪২, সূরা বাকারাহ-এর ব্যাখ্যায়), আল্লামা তাবাতাবাই (রহ.) ইসলাম ও অন্যান্য প্রাচীন জাতির দৃষ্টিতে নারীর অধিকার, ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক অবস্থান তুলনামূলকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে তুলে ধরা হলো তাঁর বিশ্লেষণের একটি অংশ।
নারীর জীবন প্রাচীন উন্নত সভ্যতাগুলোতে: ইরান, চীন, মিশর ও ভারত
অতীতের যেসব জাতিকে “উন্নত ও সভ্য” বলা হয়, সেগুলো ছিল এমন সমাজ—যাদের জীবন চলত ঐতিহ্য ও প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির উপর; কোনো সংবিধান বা ধর্মীয় গ্রন্থভিত্তিক ব্যবস্থা ছিল না। এ তালিকায় ছিল:
১.প্রাচীন চীন
২.প্রাচীন ভারত
৩.প্রাচীন মিশর
৪.প্রাচীন ইরান
৫.এবং অন্যান্য অনুরূপ সভ্যতা
এই সব জাতিতে নারীর মৌলিক অবস্থা ছিল এক ও অভিন্ন: নারীর ছিল না কোনো স্বাধীনতা—না সিদ্ধান্তে, না কাজে। তার ছিল শুধু আনুগত্য; অধিকার ছিল পুরুষের।
নারীকে জীবনের প্রতিটি ধাপে পুরুষের অভিভাবকত্বের অধীনে থাকতে হতো। সে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না, এমনকি সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই (শাসন, বিচার, প্রশাসন)—অংশগ্রহণের অনুমতি ছিল না।
নারীর ওপর চাপানো দায়িত্বগুলো
যে নারী কোনো অধিকার পেত না, তাকেই দেওয়া হতো বহু দায়িত্ব—
১-পুরুষের সকল শ্রমমূলক কাজ—কৃষিকাজ, সংগ্রহ, জ্বালানি সংগ্রহ—সবই নারীর ওপর বর্তাত।
২-পাশাপাশি গৃহকর্ম, সন্তানের লালন–পালন, এবং সর্বক্ষণ স্বামীর আনুগত্য ছিল বাধ্যতামূলক। নারীকে কাজ করতে হতো, কিন্তু সম্পত্তি বা সিদ্ধান্তের মালিকানা ছিল না।
কিছু সীমিত অধিকার—কিন্তু স্বাধীনতা নয়
এই সভ্যতাগুলোর নারীরা সাধারণত পশুসম্মত আচরণ থেকে কিছুটা রক্ষা পেত। তাদের হত্যা করা হতো না, সম্পত্তি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিতও করা হতো না। মাঝে মাঝে—
১. স্ত্রী সম্পত্তি পেতে পারত (যদিও সিদ্ধান্তের অধিকার পুরুষের)
২. বিয়ের অনুমতি থাকত (কিন্তু স্বামী নির্বাচন স্বাধীন ছিল না)
অর্থাৎ, মালিকানা ছিল, স্বাধীনতা ছিল না।
পুরুষ চাইলে:
- সীমাহীন সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারত,
- ইচ্ছেমতো তালাক দিতে পারত,
- স্ত্রী মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় বিবাহ করত।
কিন্তু নারী?
- স্বামী মারা গেলে আজীবন বিধবা,
- পুনরায় বিবাহ নিষিদ্ধ,
- বাইরে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি ছিল না।
চীন: নারী—কেনাবেচার বস্তু
চীনে বিবাহ ছিল এক ধরনের দাসত্বমূলক চুক্তি; নারী নিজেকে “বিক্রি” করত। তাই তাকে কোনো সিদ্ধান্ত বা সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হতো না।
১. নারী উত্তরাধিকার পেত না
২. একই টেবিলে বসে খাওয়ার অধিকার ছিল না—এমনকি নিজের ছেলের সঙ্গেও নয়
৩. দুই বা একাধিক পুরুষ একই নারীকে যৌথভাবে বিবাহ করতে পারত; সন্তানকে গণ্য করা হতো সেই পুরুষের, যার সঙ্গে সন্তান বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ
ইরান: শ্রেণিব্যবস্থা নারীর ভাগ্য নির্ধারণ করে
ইরানে জাতিগত শ্রেণিবিভেদ নারীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করত।
১- উঁচু শ্রেণির নারী মাঝে মাঝে শাসন ক্ষমতা বা এমনকি রাজত্ব পর্যন্ত পেত
২- পিতা–ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহ বৈধ মনে করা হতো
৩- নিম্নশ্রেণির নারীদের এমন কোনো অধিকার ছিল না
ভারত: নারী—স্বামীর শরীরের অঙ্গ
ভারতে বিশ্বাস ছিল—নারী স্বামীর দেহের একটি অংশ। তাই:
১. স্বামী মারা গেলে স্ত্রীও মৃত্যুর আগুনে পুড়ে মরত (সতি প্রথা)
২. যদি সে বেঁচেও থাকত, তাকে চরম অবমাননা ও নিপীড়নের মধ্যে জীবন কাটাতে হতো
৩. মাসিক চলাকালে নারীকে “অশুদ্ধ”, “নাপাক” ও “অমঙ্গল” মনে করা হতো
তার স্পর্শে যে কোনো বস্তু অপবিত্র বলে বিবেচিত হতো।
নারী—মানুষ নয়, আবার পশুও নয়
আল্লামা তাবাতাবাই (রহ.) লিখেছেন: নারীরা না মানুষ হিসেবে স্বীকৃত ছিল, না পশু; বরং দুইয়ের মাঝখানে একটি নিম্নতর সত্তা।
নারীকে দেখা হতো এমন সত্তা হিসেবে—
১.যাকে ব্যবহার করা যায়,
২.কিন্তু অধিকার দেওয়া যায় না,
৩.যে শ্রম দেবে,
৪.কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে না।
শিশু ছেলে যেমন অভিভাবকের অধীনে থাকে—নারী ছিল ঠিক সেই অবস্থায়; পার্থক্য শুধু— সন্তান বড় হলে স্বাধীন হয়, কিন্তু নারী—আজীবন পরনির্ভর।
(চলবে ….)
সূত্র: তাফসিরে আল-মিজান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৯৫।



