কাতারে ইসরায়েলি হামলার উল্টো ফল: আরব-ইসলামী বিশ্বের অভূতপূর্ব ঐক্য
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কাতারে ইসরায়েলি হামলার উল্টো ফল: আরব-ইসলামী বিশ্বের অভূতপূর্ব ঐক্য; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান
মিডিয়া মিহির: আরব ও ইসলামী বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরায়েলের হামলাকে এক কাপুরুষোচিত আগ্রাসন হিসেবে আখ্যায়িত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা কাতারের প্রতি পূর্ণ সংহতি ঘোষণা করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এই হামলা কার্যত ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের ভঙ্গুর স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াকে ভেঙে দিয়েছে।
সোমবার কাতারের রাজধানী দোহায় আরব লীগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (OIC)-এর রাষ্ট্রপ্রধানরা এক জরুরি সম্মেলনে মিলিত হন। এই শীর্ষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় মাত্র ছয় দিন পর, যখন ইসরায়েল দোহায় একটি ভবনে বিমান হামলা চালায়। ঐ ভবনে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত গাজা শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেছিল।

কাতারের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের মূল আলোচ্যবিষয় ছিল দোহায় ইসরায়েলি হামলা এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ধারাবাহিক লঙ্ঘন।
কাতারের সরকারি বার্তা সংস্থার মাধ্যমে প্রকাশিত চূড়ান্ত ঘোষণায় বলা হয়েছে, আরব ও ইসলামী দেশগুলোর নেতারা ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে দোহায় সংঘটিত ইসরায়েলি হামলাকে কঠোরতম ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। হামলাটি ছিল আবাসিক এলাকায়, যেখানে কাতার কর্তৃক আলোচনাকারী প্রতিনিধিদের জন্য নির্ধারিত থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও বহু স্কুল, কিন্ডারগার্টেন এবং কূটনৈতিক মিশন ছিল। এই বর্বর হামলায় বহু মানুষ শহীদ হন, যার মধ্যে একজন কাতারি নাগরিকও ছিলেন। অনেকে আহত হন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই আক্রমণ কাতারের বিরুদ্ধে সরাসরি পরিচালিত এক সুস্পষ্ট আগ্রাসন, যা ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক চরিত্রকে প্রকাশ করেছে এবং তার অপরাধের তালিকায় নতুন সংযোজন করেছে। এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আরব ও ইসলামী নেতারা “ভ্রাতৃপ্রতিম কাতার রাষ্ট্রের” প্রতি তাদের নিঃশর্ত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। গাজায় যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় কাতারকে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তারা ঘোষণা করেছেন, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কাতারের পাশে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। তাদের মতে, এটি উপসাগরীয় রাষ্ট্র কাতারের সার্বভৌমত্বের ওপর সুস্পষ্ট আঘাত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা ইসরায়েলকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। এই নীরবতা ইসরায়েলকে ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনে উসকানি দিচ্ছে, দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি জিইয়ে রাখছে এবং ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে। এর ফলে বিদ্যমান নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থাই ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
আরব ও ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জরুরি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসন অবিলম্বে থামানো হয়। তারা সতর্ক করেছেন, এই নিষ্ক্রিয়তা অব্যাহত থাকলে তার ভয়াবহ প্রভাব গোটা অঞ্চল এবং আন্তর্জাতিক শান্তি-নিরাপত্তার ওপর পড়বে। তাদের সতর্কবার্তায় শুধু কাতারে হামলাই নয়, বরং গাজায় চলমান নৃশংস আগ্রাসন, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন এবং লেবানন, সিরিয়া ও ইরানে ধারাবাহিক হামলার কথাও স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আঞ্চলিক গতিশীলতায় নতুন মোড়
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কাতারি আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ এবং সার্বভৌম ভূখণ্ডে হামলা ব্যাপক নিন্দা সৃষ্টি করেছে এবং আঞ্চলিক গতিশীলতায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা উল্টো ফল বয়ে এনে ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েকটি আরব দেশের ভঙ্গুর স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াকে কার্যত থামিয়ে দিয়েছে। এই হামলা আঞ্চলিক ঐক্যের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে এবং দোহায় OIC ও আরব লীগের যৌথ জরুরি সম্মেলন ডেকে এনেছে।
এই সম্মেলনের শক্তিশালী ও অভিন্ন প্রতিক্রিয়াকে ইসরায়েলের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সদস্য এবং গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী কাতারকে লক্ষ্যবস্তু বানানো ইসরায়েলের গুরুতর কৌশলগত ভুল ছিল।
অনেকেই একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখে বৃহত্তর আগ্রাসী নীতির অংশ হিসেবে দেখছেন, যেখানে ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব উপেক্ষা করে আসছে। এর ফলে আরব ও ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে নতুনভাবে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে যে, ইসরায়েলের প্রকাশ্য আগ্রাসন এখন পুরো অঞ্চলের জন্য হুমকি।
দোহা ঐকমত্য: কৌশলগত পরিবর্তনের সূচনা
জরুরি সম্মেলনের ফলাফল পূর্ববর্তী বিভক্ত ও দুর্বল প্রতিক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেছে যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। তারা শুধু কথার নিন্দায় সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব পদক্ষেপের দাবি তুলেছে, যেমন— আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা।
ফলে, যেসব সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, তাদেরও জনমতের চাপের কারণে কাতারের পাশে অবস্থান নিতে হয়েছে। এভাবে মুসলিম বিশ্বের জনগণের ঐক্যবদ্ধ অনুভূতি রাজনৈতিক মঞ্চে প্রতিফলিত হয়েছে।
সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রকল্পের অনিশ্চয়তা
এই সংকটের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ও সুস্পষ্ট প্রভাব হলো তথাকথিত স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ার কার্যত ধ্বংস হয়ে যাওয়া। ইসরায়েল-সৌদি আরব চুক্তির সম্ভাবনা—যা ইসরায়েলি ও মার্কিন কূটনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল—এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।
ঘটনার এই ধারাবাহিকতা ইসরায়েলবিরোধী দেশগুলোর দীর্ঘদিনের বক্তব্যকেও শক্তিশালী করেছে— স্বাভাবিকীকরণ একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা, যা তেলআবিবের অপরাধী শাসনকে আরও শক্তিশালী করে।
কাতারে ইসরায়েলের এই হামলা এক গুরুতর কৌশলগত ভুলে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু ফিলিস্তিন ইস্যুকে আবারও আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনেনি, বরং কূটনৈতিক একীকরণের ভ্রান্ত ধারণাকেও ভেঙে দিয়েছে।
দোহা সম্মেলনে যে শক্তিশালী ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, তা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে: অঞ্চলের ভবিষ্যৎ এখানকার প্রকৃত মালিক ও নেতৃত্বদাতা দেশগুলোর হাতে নির্ধারিত হবে।