আধুনিক আত্মবিস্মৃতি থেকে মুক্তির পথ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির:হুজ্জাতুল ইসলাম হাদি আজমি, আলেমে আলে মুহাম্মদ (আ.) এর আলী ফিকাহ স্কুলের পরিবার ফিকাহ গবেষণা চক্রের সচিব, সঙ্গে আলাপে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রধান দায়িত্বগুলোর মূল দিকগুলো ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, যদি আমরা নবী করিম (সা.)-এর লক্ষ্য ও মিশনের দিকে মনোযোগ দিই, তবে প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং তাওহীদকেন্দ্রিক গঠনমূলক আলোচনা প্রচার করা। হাদিসে এসেছে: لا اله الا الله حصنی লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ হেসনি— অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার লাল দাগ বা সীমারেখা হচ্ছে তাওহীদ। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল নৈতিকতা (আখলাক), যেটিকে নবী করিম (সা.) বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আজমি বলেন, আযানে আশহাদু আননা মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ উচ্চারণ করার মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝি যে, নবীগণ ফিতরাতের ভিত্তিতে (فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِی فَطَرَ النَّاسَ عَلَیْهَا) মানুষকে তাদের মূল প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাওহীদের ধারা শক্তিশালী করতে এসেছেন। অথচ আজকের পশ্চিমা সভ্যতা ও অবিশ্বাসের ধারার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাওহীদ থেকে বিচ্যুতি। তারা মানুষকে সমাজের কেন্দ্রস্থলে বসিয়ে দিয়ে বলে শিল্প কেবল শিল্পের জন্য, রাজনীতি ধর্ম থেকে আলাদা ইত্যাদি— যেটি আসলে সেক্যুলারিজমের প্রসার ঘটায় এবং তাওহীদের বিপরীতে দাঁড়ায়। অথচ আল্লাহ কোরআনে বলেছেন: وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ— অর্থাৎ সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু ইবাদতের জন্য। এমনকি নবুওয়াতও আবদিয়তের অধীনে সংজ্ঞায়িত।
তাওহীদ জাগ্রত করার উপায়
তিনি ব্যাখ্যা করেন, আল্লাহর বান্দা হওয়ার প্রশিক্ষণের জন্য অনেক মুস্তাহাব আমল ও দোয়া রয়েছে। যেমন, নামাজ শুরু করার আগে বলা হয়: إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ— অর্থাৎ আমার নামাজ, কোরবানি, জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহর জন্য। এগুলো আসলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাওহীদকে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি অনুশীলন।
তিনি স্মরণ করান, নবী করিম (সা.) তাওহীদকে চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের প্রতিটি স্তরে প্রসারিত করেছেন। যেমন আখলাকের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে: بُعِثتُ لِاُتمِمَّ مکارم الأخلاق— আমি পাঠানো হয়েছি উৎকৃষ্ট চরিত্র পূর্ণ করার জন্য। এর মানে কেবল ভালো মানুষ হওয়া নয়, বরং কেন আমরা কাউকে ভালোবাসব— কারণ সে আল্লাহর সৃষ্টি। কেন নারীর হিজাব জরুরি— সেটিও তাওহীদের কারণে।
আজমি বলেন, নবী করিম (সা.) সমাজকে তাওহীদকেন্দ্রিক সভ্যতা গঠনের জন্য চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণ— এই তিন দিকেই প্রভাব রেখেছেন। যেমন:
১. চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিদিনের নামাজ দ্বারা তাওহীদের বিষয়গুলো বারবার স্মরণ করানো হয়।
২. আচরণের ক্ষেত্রে আমলী ফিকাহ দ্বারা প্রতিটি কাজের তাওহীদী রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে; যেমন: আহাল্লাল্লাহুল বাই’আ ওয়া হাররামার রিবা— বাণিজ্যকে হালাল আর সুদকে হারাম করা হয়েছে।
আধুনিক আত্মবিস্মৃতি
তিনি বলেন, আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা মানবকেন্দ্রিকতা (হিউম্যানিজম) প্রচার করছে। কিন্তু আল্লাহ বলেন: نَسُوا اللَّهَ فَأَنسَاهُمْ أَنفُسَهُمْ— যারা আল্লাহকে ভুলে যায়, আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেও ভুলিয়ে দেন। ফলে পশ্চিমা সমাজে মানুষ মিথ্যা প্রয়োজন সৃষ্টি করছে, যেমন অস্বাভাবিক ভোগবিলাস, অবৈধ যৌন সম্পর্ক, লিঙ্গ পরিবর্তন— তবুও তারা তৃপ্তি পায় না, শেষমেশ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়।
আজমি মনে করেন, আধুনিক কৃত্রিম প্রয়োজনগুলো পরিবারে তাওহীদী শিক্ষার ঘাটতি তৈরি করছে। অথচ তাওহীদ জন্মগত ও প্রাকৃতিক বিষয়, যা পরিবার থেকেই শৈশবে গড়ে তোলা যায়। এর মানে এই নয় যে বাবা-মা শুধু তসবিহ হাতে বসে থাকবে, বরং তাদের জীবনাচরণ ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী হতে হবে। যেমন: পরিবার একসঙ্গে ওজু করে নামাজে দাঁড়ালে, সন্তানও স্বাভাবিকভাবে তাওহীদী পরিবেশে বেড়ে উঠবে।
উপসংহার
তিনি বলেন, মানুষ জন্মগতভাবে পবিত্র ফিতরাত নিয়ে আসে। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব হলো এই ফিতরাতকে রক্ষা করা, যাতে তা অবিশ্বাস বা শিরক দ্বারা কলুষিত না হয়। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন: لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ— আমরা মানুষকে শ্রেষ্ঠ আকারে সৃষ্টি করেছি। যদি মানুষ এই অবস্থা বজায় রাখতে পারে, তবে সেটিই হবে নবী করিম (সা.)-এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য— অর্থাৎ মানুষকেন্দ্রিক নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাওহীদকেন্দ্রিক সমাজ।