বিশেষ সংবাদইতিহাসধর্ম ও বিশ্বাস

মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়, ইসলামী সমাজের কেন্দ্রবিন্দু

উম্মে যাহরা আহমেদ | প্রকাশ: ২৮ আগস্ট, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়; বরং এটি ইসলামী সমাজের হৃদস্পন্দন, একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান, যার ভেতর নিহিত রয়েছে ইবাদত, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক সংহতি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের বহুমাত্রিক কার্যক্রম।
মসজিদের প্রাথমিক ভূমিকা
রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনায় সর্বপ্রথম যে প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি ছিল মসজিদে নববী। এটি শুধুমাত্র ইবাদতের স্থান নয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের প্রধান কেন্দ্র ছিল। এখান থেকেই ইসলামের মৌলিক নীতিমালা বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপিত হয়েছিল।
প্রথমবারের মতো মসজিদকে কেন্দ্র করে এক নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল—যেখানে শাসককে বলা হতো ‘ইমাম’, জনগণ ছিল ‘উম্মত’ এবং শাসনকেন্দ্র ছিল ‘মসজিদ’। ফলে মসজিদ শুধুমাত্র ধর্মীয় কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং ধর্মীয়, শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, বিচারিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদ ছিল মুসলমানদের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে কোরআন-হাদিস শিক্ষা, ইসলামী বিধি-বিধান, এমনকি প্রাথমিক সাক্ষরতার দীক্ষাও প্রদান করা হতো। মুসলিম শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার আলো গ্রহণ করত মসজিদ থেকেই। এর মাধ্যমে মসজিদ সমাজে এক সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিচার ও ন্যায়বিচারের কেন্দ্র
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে মসজিদ ছিল পূর্ণাঙ্গ আদালত। এখানেই আইন প্রণয়ন, বিচারকার্য সম্পন্ন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতো। কোনো সামাজিক বিরোধ বা বিরোধপূর্ণ মামলার সমাধান মসজিদকেন্দ্রিক বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই করা হতো।
সামাজিক সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক
মসজিদ ছিল শ্রেণিবৈষম্য ভাঙার শক্তিশালী মাধ্যম। ধনী-গরিব, আরব-অনারব, কালো-সাদা সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সামনে সমানভাবে নামাজ আদায় করত। ফলে মসজিদ পরিণত হয়েছিল ভ্রাতৃত্ব, সংহতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীকে।
রাজনৈতিক ভূমিকা
ইসলামের প্রারম্ভ থেকেই মসজিদ রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধ পরিচালনা, রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, উম্মতের ঐক্য রক্ষা—সবই হতো মসজিদকে কেন্দ্র করে। তাই বলা যায়, মসজিদ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
আজকের যুগেও মসজিদের সেই বহুমাত্রিক ভূমিকা পুনর্জীবিত করা অপরিহার্য। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মসজিদকে বিপ্লবের দুর্গ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইসলামি বিপ্লব ও আরোপিত যুদ্ধের সময় মসজিদই ছিল সংগঠন, রণাঙ্গনে যোদ্ধা প্রেরণ, নারীদের সহায়তা ও জনগণের ঐক্যের প্রধান কেন্দ্র।
বর্তমানে ইরানসহ বিশ্বের অনেক দেশ হাওজায়ে ইলমিয়ার নারী বিভাগ কিংবা বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগ নিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের মসজিদকেন্দ্রিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করছে, যাতে মসজিদের ভুলে যাওয়া ভূমিকা আবারো সমাজে জাগ্রত হয়। প্রতিটি মসজিদের পরিচালনা কমিটি এবং শহরের মসজিদ কাউন্সিলে একজন নারী আলেমার অন্তর্ভুক্তি হলে বহু সামাজিক সমস্যার সমাধান সহজ হবে। পাশাপাশি মসজিদকেন্দ্রিক পাড়াপ্রতিবেশ সমাজে নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
মসজিদ কেবল নামাজের স্থান নয়; এটি ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র। মসজিদকে ইবাদত, শিক্ষা, বিচার, সংস্কৃতি, সামাজিক ঐক্য ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কেন্দ্র হিসেবে পুনর্জীবিত করা আজ সময়ের দাবি। যদি আমরা মসজিদের প্রকৃত ভূমিকা পুনর্নির্মাণ করতে পারি, তবে সমাজ থেকে অন্যায়, বিভেদ ও অবক্ষয় দূর হবে এবং ইসলামী ঐক্য ও সভ্যতার নবজাগরণ ঘটবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button