তাওহীদের বহুমাত্রিক প্রতিফলন ধর্মীয় পরিসরে
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ধর্ম মানবসভ্যতার চিন্তা ও নৈতিকতার ভিত্তি। পৃথিবীর ধর্মগুলোকে সাধারণত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—আসমানি (ঐশ্বরিক) ধর্ম এবং অনাসমানি (অঐশ্বরিক) ধর্ম। অঐশ্বরিক ধর্মগুলো যেমন হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শিন্তো বা কনফুসীয় মতবাদ, সাধারণত বহু দেবতার বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে, আসমানি ধর্মগুলো—ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম—ঐশ্বরিক উৎস থেকে আগত এবং একেশ্বরবাদ বা তাওহিদকেই তাদের মূল ভিত্তি হিসেবে ধারণ করেছে। তবে এই তাওহিদের ব্যাখ্যা, গভীরতা ও বিশুদ্ধতা তিন ধর্মে এক নয়।
অঐশ্বরিক ধর্মে ঈশ্বর ধারণা
অঐশ্বরিক ধর্মগুলো ঐশ্বরিক প্রকাশনাভিত্তিক নয়; এগুলো মানুষের দর্শন, ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এসব ধর্মে একক সৃষ্টিকর্তার ধারণা নেই; বরং বহুদেববাদ, মানুষপূজা, প্রাণীপূজা কিংবা মূর্তিপূজা প্রধান বিশ্বাসরূপে বিদ্যমান। তাই ইসলামি পরিভাষায় এগুলোকে “অতৌহিদি ধর্ম” বলা হয়।
আসমানি ধর্ম ও তাওহিদের ভিত্তি
ঐশ্বরিক ধর্মগুলো—ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম—আল্লাহর প্রেরিত বার্তা বহন করে, এবং এই ধর্মগুলোর মূল আহ্বান এক আল্লাহর উপাসনা।
তবে ইসলামে তাওহিদের ধারণা সবচেয়ে বিস্তৃত, যৌক্তিক ও সুসংহত রূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে।
ইসলামে তাওহীদের বিভিন্ন স্তর
ইসলাম তাওহিদকে বহুস্তরে বিশ্লেষণ করেছে। নিচে এর প্রধান শাখাগুলো উপস্থাপন করা হলো—
১️ তাওহিদে জাত (توحيد ذات)
আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়; তাঁর কোনো সাদৃশ্য বা অংশ নেই। এটি কুরআনের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর সূরা সূরা আল-ইখলাসের স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
বলুন, তিনি আল্লাহ, এক; আল্লাহ অমুখাপেক্ষী; তিনি জন্ম দেননি, তাঁকে জন্মও দেওয়া হয়নি; আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। (সূরা আল-ইখলাস, আয়াত ১–৪)
২️ তাওহিদে সিফাত (توحيد صفات)
আল্লাহর গুণাবলি যেমন—জ্ঞান, জীবন, ক্ষমতা, করুণা—সবই তাঁর সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ধারণা অনুসারে, আল্লাহর গুণাবলি আলাদা কোনো অস্তিত্ব নয়, বরং তাঁর সত্তারই প্রকাশ।শিয়া মতবাদে এটি সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত, যদিও কিছু সুন্নি আলেম গুণ ও সত্তাকে পৃথক করে দেখেছেন।
৩️ তাওহিদে খালিকিয়াত (توحيد خالقيّة)
সৃষ্টির অধিকার একমাত্র আল্লাহর। পৃথিবী ও আকাশের প্রতিটি সৃষ্টিই তাঁর সৃষ্টি।
আল্লাহ তাআলা বলেন—
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ۚ هَلْ مِنْ خَالِقٍ غَيْرُ اللَّهِ يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ
“হে মানুষ, তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা আছে কি, যিনি তোমাদের আকাশ ও জমিন থেকে রিজিক দেন? আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; তাহলে তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছ? (সূরা ফাতির, আয়াত ৩)
৪️ তাওহিদে রুবুবিয়াত (توحيد ربوبية)
বিশ্বজগতের পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা একমাত্র আল্লাহর হাতে।
আল্লাহ বলেন—
لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا ۚ فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ
যদি আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য থাকত, তবে উভয়ই বিনষ্ট হয়ে যেত। সুতরাং আল্লাহ, আরশের অধিপতি, তাঁদের বর্ণনা থেকে পবিত্র।”
(সূরা আল-আনবিয়া, আয়াত ২২)
৫️ তাওহীদে হাকিমিয়াত (توحيد حاكمية)
বিধান ও শাসনের অধিকার আল্লাহরই। তিনি সকল বিষয়ে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী। আল্লাহ বলেন—
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ يَقُصُّ الْحَقَّ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِينَ
হুকুম তো কেবল আল্লাহরই; তিনি সত্য প্রকাশ করেন, এবং তিনিই সর্বোত্তম বিচারক।(সূরা আল-আন‘আম, আয়াত ৫৭)
৬️ তাওহীদে তাশরিয়া (توحيد تشريع)
আইন প্রণয়নের অধিকার একমাত্র আল্লাহর। মানুষ তাঁর অবতীর্ণ বিধান অনুসারে চলবে। আল্লাহ বলেন—
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
“যারা আল্লাহ অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই কাফির।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৪৪)
৭️ তাওহীদে ইবাদত (توحيد عبادة)
ইবাদত বা উপাসনা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত হবে। অন্য কোনো সত্তার ইবাদত করা শিরক। আল্লাহ বলেন—
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
“আমরা প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল পাঠিয়েছি এই বলে—‘আল্লাহর উপাসনা করো এবং তাগুত থেকে বিরত থাকো। (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৩৬)
এবং সূরা ফাতিহায় বলা হয়েছে—
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
(সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত ৫)
৮️ তাওহীদে শাফাআত ও মাগফিরাত (توحيد شفاعة و مغفرة)
ক্ষমা ও সুপারিশের অধিকার একমাত্র আল্লাহর। কেউ তাঁর অনুমতি ব্যতীত কাউকে ক্ষমা করতে পারে না।
قُل لِّلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَّهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
“বলুন, সমস্ত শাফাআত আল্লাহরই জন্য। আকাশ ও জমিনের মালিকানা তাঁরই, এবং তোমরা সবাই তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। (সূরা আজ-যুমার, আয়াত ৪৪)
وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ
আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে, যে গুনাহ মাফ করতে পারে? (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৫)
ইহুদিধর্মে তাওহীদের বিকৃতি
ইহুদিধর্মে একেশ্বরবাদ ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাওরাতে বহু মানবিক বর্ণনা যুক্ত হয়েছে। সেখানে ঈশ্বরকে অনেক সময় মানুষসদৃশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে—যিনি রাগান্বিত, ঈর্ষান্বিত কিংবা ভীত। তাওরাতে বর্ণিত—আদম ও হাওয়াকে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করার কারণ ছিল, “ঈশ্বর আশঙ্কা করেছিলেন, তারা যেন তাঁর মতো জ্ঞানী ও অমর না হয়।(আদিপুস্তক ৩:২২)
আবার লেখা আছে—“ঈশ্বরের পুত্ররা মানুষের কন্যাদের দেখল যে তারা সুন্দর, এবং তারা তাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করল। (আদিপুস্তক ৬:২) এমন বর্ণনা তাওহীদের শুদ্ধতা নষ্ট করে শিরক ও মানবরূপবাদে (Anthropomorphism) পরিণত হয়েছে।
খ্রিস্টধর্মে ত্রিত্ববাদ ও তাওহীদের বিকৃতি
খ্রিস্টধর্মে মূল বিকৃতি হলো ত্রিত্ববাদ (Trinity) ধারণা। এখানে আল্লাহকে এক হলেও তিন ব্যক্তিত্বে উপস্থাপন করা হয়েছে—পিতা, পুত্র (যিশু খ্রিস্ট) এবং পবিত্র আত্মা।
এই তিনজনকে সমান, চিরন্তন ও একই সত্তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু প্রথম যুগের খ্রিস্টান সমাজে এই বিশ্বাস ছিল না। এটি পরে পল (Paul)-এর প্রচারে গঠিত হয়, এবং নিসিয়া (৩২৫ খ্রি.), কনস্টান্টিনোপল (৩৮১ খ্রি.), ও কালসেডন (৪৫১ খ্রি.) গির্জা কাউন্সিলগুলোতে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান বিশ্বাসের অংশ হয়।
ইসলামে তাওহীদ হলো ঈমানের কেন্দ্রবিন্দু—যে বিশ্বাস ঘোষণা করে:
لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ، مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ
আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।
অন্যদিকে, ইহুদিধর্ম ও খ্রিস্টধর্মে তাওহীদের ধারণা সময়ের সঙ্গে বিকৃত হয়ে মানবকেন্দ্রিক ও বহু-ব্যাখ্যায় আবৃত হয়েছে। ফলে ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যেখানে একত্ববাদের ধারণা সর্বাধিক বিশুদ্ধ, যৌক্তিক ও পূর্ণাঙ্গভাবে সংরক্ষিত রয়েছে।
পাদটীকা
১.সূরা ফাতির, আয়াত ৩।
২. সূরা আল-আনবিয়া, আয়াত ২২।
৩. সূরা আল-আন‘আম, আয়াত ৫৭।
৪. সূরা আন-নিসা, আয়াত ৬৪।
৫. সূরা আন-নাহল, আয়াত ৩৬।
৬. সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত ৫।
৭. সূরা আজ-যুমার, আয়াত ৪৪।
৮. সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৩৫।
৯. সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৪৪।
১০. সুবহানী, জাফর; আল–ইলাহিয়্যাত, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১১–১০৭, (কোম): আল-মারকায আল-আলামি লিদিরাসাত আল-ইসলামিয়্যা, চতুর্থ সংস্করণ, ১৪১৩ হিজরি।
১১.বাইবেল, আদিপুস্তক (Book of Genesis), অধ্যায় ২: আয়াত ১৬–২৫ এবং অধ্যায় ৩: আয়াত ১–৪।
১২. আদিপুস্তক, অধ্যায় ৫: আয়াত ২২ ও ২৪।
১৩. আদিপুস্তক, অধ্যায় ৬: আয়াত ১ ও ২।
১৪. আমাদের প্রভু যিশু খ্রিস্ট (Our Lord Jesus Christ), জন ওয়ালভোর্ড (John Walvoord); অনুবাদ: মেহরদাদ ফাতেহি; পৃষ্ঠা ২।
১৫. খ্রিস্টধর্ম পরিচিতি (An Introduction to Christianity), লেখক দল; সম্পাদনা: হোমায়ুন হুমায়তি (Homayoun Hemmati); পৃষ্ঠা ১২৭।
১৬. ধর্মীয় বিশ্ব (The Religious World), লেখক দল; অনুবাদ: আব্দুররহিম গোয়াহী; প্রকাশক: দফতারে নাশরে ফারহাংগে ইসলামী, ১৩৭৪ হিজরি শমসি (১৯৯৫ খ্রি.); পৃষ্ঠা ৭৩৪।



