ইমাম সাদিক (আ.): কোরআনের গভীর অর্থ উপলব্ধিতে মানুষের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন । প্রকাশ:১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পবিত্র কোরআন হেদায়েতের গ্রন্থ, তবে এর পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল উপলব্ধির জন্য এমন এক ক্ষমতা প্রয়োজন যা সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যের বাইরে। কোরআনের আয়াতসমূহ, বিশেষ করে «وَ مَا یَعْلَمُ تَأْوِیلَهُ إِلَّا اللّهُ وَ الرّاسِخُونَ فِی العِلْمِ» ইঙ্গিত করে যে প্রকৃত ব্যাখ্যা কেবলমাত্র এক বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে—অর্থাৎ নবী ও তাঁর আহলে বাইতের কাছে—নিহিত। এই ব্যাখ্যা ঐ আয়াতের অধীনে বর্ণিত সমস্ত হাদিসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই নির্ভরযোগ্য সুন্নাহ আমাদের শিক্ষা দেয় যে তাদের (আহলে বাইত) কাছে ফিরে যাওয়া শুধু একটি নৈতিক পরামর্শ নয়, বরং একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক নীতি; কেননা ব্যাখ্যা, পাঠ বা অনুবাদ থেকে ভিন্ন, আর কোনো নির্ভুল শিক্ষক ছাড়া কোরআনের গভীর অর্থে প্রবেশ করা মানে পথভ্রষ্ট হওয়া।
ইমাম সাদিক (আ.) এক বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন:
«لَیْسَ شَیْءٌ بِأَبْعَدَ مِنْ قُلُوبِ الرِّجَالِ مِنْ تَفْسِیرِ الْقُرْآنِ»؛
অর্থাৎ—মানুষের অন্তর থেকে কোরআনের ব্যাখ্যার মতো দূরের আর কিছু নেই। (আল-মাহাসিন, খণ্ড ১, পৃ. ২৬৮)
এমনই এক অনুরূপ বর্ণনায় ইমাম বাকির (আ.) জাবির জুফিকে উদ্দেশ করে বলেন:
«یَا جَابِرُ لَیْسَ شَیْءٌ أَبْعَدَ مِنْ عُقُولِ الرِّجَالِ مِنْ تَفْسِیرِ الْقُرْآنِ إِنَّ الْآیَةَ یَکُونُ أَوَّلُهَا فِی شَیْءٍ وَ آخِرُهَا فِی شَیْءٍ وَ هُوَ کَلَامٌ مُتَّصِلٌ مُنْصَرِفٌ عَلَى وُجُوهٍ.»
অর্থাৎ—“হে জাবির, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির জন্য কোরআনের ব্যাখ্যার মতো দূরের আর কিছু নেই; কারণ একটি আয়াতের শুরু হতে পারে এক প্রসঙ্গে আর তার শেষ অংশ হতে পারে আরেক প্রসঙ্গে, অথচ এটি একটি ধারাবাহিক বাক্য, যা বিভিন্ন অর্থ ও দিক নির্দেশ করে।” (আল-মাহাসিন, খণ্ড ২, পৃ. ৩০০)
এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে মানব বুদ্ধি একা কোরআনের গুপ্ত স্তর ও ওহীর প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। মানুষের বুদ্ধি যদিও দৈনন্দিন বিষয়গুলোতে কিছুটা সাধারণ ও তুলনীয়, কিন্তু কোরআনের উপলব্ধিতে এমন কোনো সাধারণতায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।
ইমাম (আ.) ঐ হাদিসে আরও বলেন:
«وَ فِی ذَلِکَ تَحَیَّرَ الْخَلَائِقُ أَجْمَعُونَ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ»؛
অর্থাৎ—আল্লাহ যাদের ইচ্ছা করেছেন তাঁদের বাদ দিয়ে বাকি সব সৃষ্টিই এই বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। এই বিভ্রান্তির কারণ হলো, যখন কোনো নির্ভুল ইমামের বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বকে উপেক্ষা করা হয় এবং প্রত্যেকে নিজের মতানুযায়ী কোরআনের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করে, তখন একই ঐশী বাণী থেকে ভিন্ন ভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা জন্ম নেয়।
ইমাম সাদিক (আ.) এর বক্তব্য: কেন বুদ্ধি কোরআনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা থেকে দূরে?
ইমাম সাদিক (আ.) এই আড়াল বা গোপনীয়তার দার্শনিক কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: إِنَّمَا أَرَادَ اللَّهُ بِتَعْمِیَتِهِ… أَنْ یَنْتَهُوا إِلَى بَابِهِ وَ صِرَاطِهِ
অর্থাৎ—আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন কোরআনের প্রকৃত অর্থ গোপন রাখার মাধ্যমে মানুষ যেন তাঁর দ্বার ও তাঁর পথের দিকে ধাবিত হয়। এই দ্বার ও পথ হচ্ছে আহলে বাইত, যারা কিতাবের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের বাহক। ফলে কোরআনের ব্যাখ্যা থেকে মানুষের বুদ্ধির এই “দূরত্ব” আসলে পূর্বপরিকল্পিত ও লক্ষ্যনির্দিষ্ট, যাতে আল্লাহর ইবাদত ইমামদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
তিনি আরও বলেন: وَ أَنْ یَنْتَهُوا فِی قَوْلِهِ إِلَى طَاعَةِ الْقُوَّامِ بِکِتَابِهِ …
অর্থাৎ—মানুষের বক্তব্য এমন জায়গায় গিয়ে শেষ হওয়া উচিত, যেখানে তারা কিতাবের ধারক ও প্রতিষ্ঠিত নেতাদের আনুগত্যে পৌঁছায়। এর মানে, কোরআনের সঠিক উপলব্ধিতে পৌঁছাতে মানুষের বুদ্ধিকে কিতাবের ধারক (আহলে বাইত)-এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। এই যোগসূত্র ছাড়া বুদ্ধি তার প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা থেকে বের হতে পারবে না এবং ব্যাখ্যাগত উপলব্ধি অর্জন করতে পারবে না।
এরপর ইমাম সাদিক (আ.) আয়াতটি উদ্ধৃত করেন:
«وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَ إِلَى أُولِی الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِینَ یَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ …»
(যদি তারা সেটিকে রাসূল ও তাদের মধ্যকার উলিল-আমরের কাছে ফিরিয়ে নিত, তবে যারা গভীরভাবে অনুসন্ধান করে তারা এর প্রকৃত অর্থ জানতে পারত।)
তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে কোরআনের গভীর ব্যাখ্যা ও প্রকৃত অর্থ নির্ণয়ের জ্ঞান কেবলমাত্র উলিল-আমরের জন্য নির্ধারিত, অন্যরা এ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। এমনকি সামাজিক যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি স্বাভাবিক, যেমন তিনি বলেন:
«لَا یَسْتَقِیمُ أَنْ یَکُونَ الْخَلْقُ کُلُّهُمْ وُلَاةَ الْأَمْرِ»
অর্থাৎ—যদি সব মানুষ উলিল-আমর হয়ে যেত, তবে আর এমন কেউ অবশিষ্ট থাকত না যাকে আল্লাহর হুকুম-নিষেধ জানানো সম্ভব হতো।
এরপর তিনি সতর্ক করে বলেন:
«إِیَّاکَ وَ إِیَّاکَ وَ تِلَاوَةَ الْقُرْآنِ بِرَأْیِکَ …»
অর্থাৎ—নিজের মত অনুযায়ী কখনো কোরআন পাঠ ও ব্যাখ্যা করো না। কারণ মানুষ কোরআন বোঝার ক্ষমতায় সমান নয়, আর এর প্রকৃত ব্যাখ্যা কেবল সেইসব মানুষের জন্য অনুমোদিত, যারা আল্লাহর নির্ধারিত দরজা ও পথে প্রবেশ করে। এই সতর্কবার্তা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে ব্যক্তিগত বুদ্ধি কোরআনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা থেকে কতটা দূরে।
শেষে ইমাম সাদিক (আ.) বলেন:
«وَ اطْلُبِ الْأَمْرَ مِنْ مَکَانِهِ تَجِدْهُ…»
অর্থাৎ—আল্লাহর নির্দেশকে তার প্রকৃত স্থান থেকে অনুসন্ধান কর, তাহলেই তা পাবে।
সুতরাং মানুষের বুদ্ধি তখনই কোরআনের ব্যাখ্যার সবচেয়ে দূরবর্তী অবস্থান থেকে নিকটতম পথে পৌঁছাতে পারে, যখন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত ও নিষ্পাপ উৎসের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এই সংযোগই বুদ্ধিকে বিভ্রান্তি ও মতবিরোধ থেকে বের করে নিশ্চিততা ও ঐক্যের দিকে নিয়ে যায়, এবং যতটা সম্ভব ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভিন্নতা ও মতপার্থক্যকে কমিয়ে ঐক্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
কোরআনের সঠিক উপলব্ধির প্রথম ধাপ
প্রথম পদক্ষেপ হলো সেই নীতিতে অটল থাকা, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং ইমামগণ বর্ণনা করেছেন: কোরআন আহলে বাইত ছাড়া বোঝা যায় না। সুতরাং যে সব উৎস সরাসরি মাসুম ইমামদের থেকে বর্ণনা করেছে—যেমন তাফসিরে কুমি, নূরুছ্ছাকালাইন এবং সাফি—তাদেরকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। এগুলো নিজেরা কোরআনের আয়াতগুলোর “সরকারি ব্যাখ্যা”, ব্যক্তিগত মতামত নয়।
যখন কোনো মাসুম ইমামের বাণী বিদ্যমান থাকে, তখন ব্যক্তিগত রুচি বা দর্শনের ভিত্তিতে সেটিকে সীমিত বা প্রসারিত করা উচিত নয়, যদি না কোরআনের স্পষ্ট পাঠ্য বা ইমামের অন্য বাণী থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এটাই সেই সতর্কবার্তা, যা ইমাম সাদিক (আ.) হাদিসে বলেছেন: «إیّاک و إیّاک و تلاوة القرآن برأیک …» — “সাবধান! কখনো নিজের মত অনুযায়ী কোরআন পাঠ ও ব্যাখ্যা করো না।”
তাহলে প্রতিটি শিয়া বা আহলে বাইতের প্রেমিকের উচিত—এমনকি কর্তব্য—দৈনিক বা সাপ্তাহিক কোরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি সেই আয়াতগুলোর তাফসিরি হাদিসগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। এতে পাঠ শুধু “তিলাওয়াত” নয়, বরং “চিন্তাসহ তিলাওয়াত” হয়ে দাঁড়াবে এবং সেই সঙ্গে নিশ্চিত করবে যে মানুষের উপলব্ধি আহলে বাইতের শিক্ষার সীমার মধ্যেই থাকবে।
আজকের দিনে ডিজিটাল মাধ্যমের কারণে এই হাদিসগুলোতে পৌঁছানো অনেক সহজ হয়ে গেছে। যেমন জামে আল-আহাদিস নূর সফটওয়্যার এবং নির্ভরযোগ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—যেমন আল-ওহী বা মারকাজে নূর—খুব দ্রুত আয়াত ও সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো খুঁজে বের করার সুযোগ দেয়। ব্যবহারকারী শুধু কাঙ্ক্ষিত আয়াতটি প্রবেশ করাবে এবং সাথে সাথে কুমি, নূরুছ্ছাকালাইন, আল-বুরহান, সাফি এবং এমনকি বিষয়ভিত্তিক তাফসিরগুলোর সব হাদিস একত্রে দেখতে পারবে।
এই পদ্ধতির দুটি বড় উপকারিতা রয়েছে:
১- মাসুম ইমামদের বাণীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন — মানুষ ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার পরিবর্তে সরাসরি ইমামের কথাই গ্রহণ করবে।
২- ভুল বা বিচ্ছিন্ন ব্যাখ্যা থেকে সুরক্ষা — কারণ সমস্ত হাদিস একসাথে দেখা যাবে, ফলে একটি মাত্র বর্ণনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে না।