কুরআনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

কিয়ামতে দেহের পুনর্জাগরণ : কুরআনের আলোয় এক চিরন্তন সত্য

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: কুরআনের শিক্ষার আলোকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মাআদ (পুনরুত্থান বা পরকাল) মানুষের পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাবর্তন—এক নতুন জীবন, যেখানে দেহ ও আত্মা এক সুরে মিলিত হয়, এবং মানুষ তার সত্তার পূর্ণতায় আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হয়।

মানুষের চিরন্তন প্রশ্ন: মানবসভ্যতার শুরু থেকেই একটি প্রশ্ন মানুষকে ব্যাকুল করেছে—মৃত্যুর পর কী ঘটে? মানুষ মাটির দেহে বাস করে, তবু অনুভব করে তার আসল সত্তা এই পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু মৃত্যুর পরে কি কেবল আত্মা থাকে, না কি দেহও নতুন করে জীবন ফিরে পায়?

এই গভীর প্রশ্নের জবাব আল্লাহ তাআলা নিজেই কুরআনে দিয়েছেন। তাঁর বাণী অনুযায়ী, কিয়ামতের পুনরুত্থান কেবল আত্মার নয়, বরং দেহ ও আত্মার সমন্বিত পুনর্জীবন—যেখানে আত্মা আবার দেহে ফিরে আসে এবং মানুষ সম্পূর্ণ পরিচয়ে হাশরের ময়দানে দাঁড়ায়।

দেহের পুনর্জন্মের স্পষ্ট ঘোষণা

সূরা ইয়াসিনে আল্লাহ বলেনঃ

وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ الْأجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنسِلُونَ
আর যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে, তখন তারা কবর থেকে ত্বরিতগতিতে বেরিয়ে তাদের প্রভুর দিকে ধাবিত হবে। (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৫১)

এখানে “مِّنَ الْأجْدَاثِ” (কবর থেকে) শব্দটি স্পষ্টভাবে বোঝায় যে মানুষরা দেহসহ কবর থেকে পুনরুত্থিত হবে।

আল্লাহর আহ্বানে দেহধারী মানুষের সাড়া

আরেক স্থানে, আল্লাহ বলেনঃ

يَوْمَ يَدْعُوكُمْ فَتَسْتَجِيبُونَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّونَ إِن لَّبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا
সেদিন তিনি তোমাদের আহ্বান করবেন, আর তোমরা প্রশংসাসহ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেবে; আর ভাববে—তোমরা কেবল অল্প সময়ই পৃথিবীতে ছিলে। (সূরা আল–ইসরা, আয়াত ৫২)

এখানে “يدعوکم” (তিনি তোমাদের ডাকবেন) এবং “فتستجیبون” (তোমরা সাড়া দেবে) — এই শব্দযুগল প্রমাণ করে যে আহ্বান ও সাড়া দেওয়ার ঘটনাটি জীবিত, দেহধারী সত্তার ক্ষেত্রেই সম্ভব।

 মৃত দেহের অস্থি পর্যন্ত পুনর্গঠন

সূরা কিয়ামাহ মানুষকে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দেনঃ

أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَلَّن نَّجْمَعَ عِظَامَهُۥ ۝ بَلَىٰ قَٰدِرِينَ عَلَىٰٓ أَن نُّسَوِّيَ بَنَانَهُۥ
মানুষ কি মনে করে যে, আমরা তার অস্থিসমূহ একত্র করতে পারব না?
অবশ্যই পারব—বরং আমরা তার আঙুলের ডগাগুলোকেও পুনর্গঠন করতে সক্ষম। (সূরা আল–কিয়ামাহ, আয়াত ৩–৪)

بَنَانَهُ” (আঙুলের ডগা) শব্দটির উল্লেখ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ—এটি মানুষের সূক্ষ্মতম পরিচয়ের প্রতীক। অর্থাৎ, কিয়ামতের দিনে পুনর্জন্ম এমন নিখুঁতভাবে ঘটবে যে প্রতিটি মানুষ তার আসল দেহ ও বৈশিষ্ট্যসহ পুনরুত্থিত হবে, যেন কেউই অপরিচিত না থাকে।এই সব আয়াত আমাদের শেখায় যে, কিয়ামতের পুনরুত্থান কোনো বিমূর্ত প্রতীক নয়; এটি এক বাস্তব ঘটনা—যেখানে আল্লাহ তাআলার আদেশে আত্মা দেহে ফিরে আসে, এবং মানুষ পুনরায় জীবিত হয়। এই পুনর্জন্ম শুধু বিচার ও প্রতিফলের উদ্দেশ্যে নয়; বরং এটি আল্লাহর ক্ষমতা, প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ

বল, যিনি প্রথমবার এটি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই একে পুনর্জীবিত করবেন; আর তিনি সকল সৃষ্টির বিষয়ে সর্বজ্ঞ। (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৭৯)

পুনর্জীবন: বস্তুগত পুনরাবৃত্তির ঊর্ধ্বে

পুনরুত্থান বা কিয়ামতের শরীর মানে এই নয় যে দেহটি পৃথিবীর মতোই থাকবে, তার সব বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকবে। বরং কিয়ামতের শরীর হবে সেই একই বাহ্যিক পরিচয়ের ধারক, কিন্তু তার গঠন ও গুণাবলি হবে সম্পূর্ণ নতুন—যা পরকালীন জগতের জন্য উপযোগী।

আল্লাহ তাআলা সূরা ওয়াকিয়ায় বলেন:

نَحْنُ قَدَّرْنَا بَینَکُمُ الْمَوْتَ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوقِینَ  عَلَى أَن نُّبَدِّلَ أَمْثَالَکُمْ وَنُنشِئَکُمْ فِی مَا لَا تَعْلَمُونَ

আমরা তোমাদের মধ্যে মৃত্যু নির্ধারণ করেছি এবং আমরা অক্ষম নই—যে তোমাদের মতো নতুন সত্তা সৃষ্টি করব এবং এমন এক জগতে তোমাদের গড়ে তুলব, যা তোমরা চিনো না।” (সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত ৬০–৬১)

এই আয়াত আমাদের জানায়, কিয়ামতের শরীর হবে পৃথিবীর শরীরের অনুরূপ, কিন্তু তার প্রকৃতি ও শক্তি হবে ভিন্ন—যা চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুত।

 কিয়ামতের শরীর: স্থায়িত্ব রূপান্তরের প্রতীক

পরকালে সময়, ক্ষয়, বার্ধক্য—এইসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেখানে পৃথিবীর শরীর কয়েক দশকেই ক্লান্ত হয়, সেখানে কিয়ামতের শরীর হবে এমন, যা চিরকাল টিকে থাকবে। আল্লাহ বলেন: لَا یَذُوقُونَ فِیهَا الْمَوْتَ إِلَّا الْمَوْتَةَ الْأُولَى

তারা সেখানে আর কোনো মৃত্যু আস্বাদন করবে না, শুধুমাত্র প্রথম মৃত্যুটিই।” (সূরা দুখান, আয়াত ৫৬) সুতরাং, জান্নাতের শরীর হবে ক্লান্তিহীন, ব্যথাহীন, রোগমুক্ত ও চিরতাজা। এমনকি তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণ হবে এমনভাবে, যাতে কোনো ক্লান্তি বা ক্ষয় দেখা যাবে না।

অন্যদিকে, কাফের ও জালিমদের জন্য এমন শরীর সৃষ্টি হবে, যা তাদের শাস্তির উপযোগী। আল্লাহ বলেন: کُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُودًا غَیرَهَا لِیَذُوقُوا الْعَذَابَ

যখনই তাদের চামড়া পুড়ে যাবে, আমরা নতুন চামড়া সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তির স্বাদ নিতে পারে।” (সূরা নিসা, আয়াত ৫৬)

এই আয়াত শরীরের উপস্থিতি ও তার মাধ্যমে শাস্তি উপলব্ধির বিষয়টি স্পষ্ট করে—যা প্রমাণ করে, পুনরুত্থান কেবল আত্মিক নয়, বরং দেহগতও।

শরীর: পরিচয় আল্লাহর ন্যায়ের প্রতিফলন

যদি কিয়ামতে কেবল আত্মা উপস্থিত থাকত, তবে দেহের মাধ্যমে করা কাজের বিচার কীভাবে হতো? যে হাত দিয়ে কেউ সৎকর্ম করেছে বা অন্যায় করেছে, সেই হাতই তো সাক্ষী হওয়া উচিত। এ কারণেই কোরআনে বলা হয়েছে:

«الْیوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُکَلِّمُنَا أَیدِیهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُم بِمَا کَانُوا یکْسِبُونَ

আজ আমরা তাদের মুখে সিল মেরে দেব, তাদের হাত আমাদের সঙ্গে কথা বলবে, আর তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তারা কী করেছিল।” (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৬৫)

এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয়—কিয়ামতের দিন দেহের প্রত্যেক অঙ্গ থাকবে, এবং তারা সাক্ষ্য দেবে। সুতরাং, পুনরুত্থান কেবল আত্মার নয়, বরং মানুষের পূর্ণ অস্তিত্বের—দেহ ও আত্মার সম্মিলিত প্রত্যাবর্তন।

আরও পড়ুন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button