গাজায় যুদ্ধবিরতিতে নেতানিয়াহুকে বাধ্য করল যে সাতটি কারণ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: একজন বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক গাজার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আমেরিকা ও ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করে উল্লেখ করেছেন যে, নেতানিয়াহুকে এই চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য করার সাতটি কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, ফলাফল যাই হোক না কেন, প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চরম চাপ, সামরিক ময়দানে ব্যর্থতা এবং অভ্যন্তরীণভাবে পতনের মুখে দাঁড়ানো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাতানিয়াহু শেষ পর্যন্ত গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সম্মত হতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও এই যুদ্ধবিরতি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে এবং বন্দি বিনিময়ের মূল ধাপ কার্যকর হয়নি, তথাপি বিশ্লেষকদের মতে—কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা নাতানিয়াহুকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। রায় আল-ইয়াওম পত্রিকার সম্পাদক ও খ্যাতনামা ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক আবদুলবারি আতওয়ান তার সাম্প্রতিক নিবন্ধে তুলে ধরেছেন সেই সাতটি প্রধান কারণ, যা গাজায় যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ক্ষমতা থেকে নাতানিয়াহুকে কার্যত বঞ্চিত করেছে।
বিশ্ব ইসরায়েলবিরোধী
আবদুলবারি আতওয়ান যোগ করেন: এটি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশের প্রেসিডেন্টের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, যা জোর দিয়ে বলে যে ইসরায়েলের আর এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শক্তি নেই, এবং তার পশ্চিমা মিত্ররাও—আমেরিকার নেতৃত্বে—আর পুরো বিশ্বের বিপক্ষে যুদ্ধ করার ক্ষমতাও রাখে না।
তিনি আরও লিখেছেন: পুরো বিশ্বের সঙ্গে যুদ্ধ করা রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সেই যুদ্ধের মতো নয়, যা একটি অবরুদ্ধ ও ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়, যারা বসবাস করে মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারেরও কম একটি অঞ্চলে (গাজা উপত্যকা)—যেখানে কোনো বন বা পাহাড় নেই এবং যেখানে প্রায় আড়াই মিলিয়ন মানুষ বাস করে, যাদের বেশিরভাগই শিশু, নারী, প্রবীণ এবং তাদের বংশধর, যারা ফিলিস্তিনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ও গ্রামগুলো থেকে জোরপূর্বক উৎখাত হয়েছে—আমার নিজের পরিবারসহ।
এই ফিলিস্তিনি লেখক উল্লেখ করেছেন: ইসরায়েল দুই বছরের যুদ্ধ শুরু করেছিল এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে, যার অস্ত্র কম, কিন্তু দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি প্রবল; যাদের নেতাদের রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত বুদ্ধিমত্তা এবং নিজের ন্যায্য অধিকারের প্রতি গভীর বিশ্বাস; যার শিকড় হাজার বছরের ইতিহাসে এই অঞ্চলের সঙ্গেই জড়িত, এবং যারা এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা—ইসরায়েলিদের মত বিদেশ থেকে আগত দখলদার নয়।
আতওয়ান আরও বলেন: এই কারণেই ইহুদিবাদীরা এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। যদিও তারা হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য পেতে পারে, তবে রাজনৈতিকভাবে তারা ভয়াবহ পরাজয়ের মুখে পড়েছে—বিশেষত মানবিক ও গোয়েন্দা ক্ষেত্রে। আমরা এখানে আল-আকসা ঝড় অভিযানের ফলাফল নিয়ে কথা বলছি, যার দুই বছর পেরিয়ে গেছে। প্রায় সবাই একমত যে নেতানিয়াহুর চিরন্তন লক্ষ্য হচ্ছে যতদিন সম্ভব ক্ষমতায় থাকা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপটি মেনে নেওয়া কি তাকে সেই লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করবে?
১. রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যর্থতার পর ‘সময় কেনার’ চেষ্টা
নাতানিয়াহু সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক ও গোয়েন্দা ক্ষেত্রে ভয়াবহ ব্যর্থতার মুখে পড়েছেন। ফলে তিনি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সাময়িক বিরতি নিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করার মরিয়া চেষ্টা করছেন।
২. ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর পুনরায় প্রভাব বিস্তারের কৌশল
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভবিষ্যৎ প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের যুদ্ধাপরাধের মামলাকে ঠেকাতে যুদ্ধবিরতি ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছেন।
৩. দাবিকৃত সাতটি ফ্রন্টের একটিতেও ‘নিশ্চিত বিজয়’ নেই
ইয়েমেন থেকে ইরান পর্যন্ত—যে সাতটি ফ্রন্টে ইসরায়েল লড়াই করছে বলে দাবি করে, তার একটিতেও তারা স্পষ্ট কোনো জয় পায়নি। ইয়েমেনের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এখনো চলমান, ইরানও ধারণক্ষমতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছে।
৪. লেবাননে হিজবুল্লাহকে দুর্বল করতে ব্যর্থতা
ইসরায়েলের বারবার আক্রমণের পরও হিজবুল্লাহর অস্ত্র মজুদ অটুট রয়েছে। বরং খবর এসেছে—সংগঠনটি নতুন কৌশলে প্রবেশ করতে যাচ্ছে এবং নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন উৎপাদন গতি ফিরে পাচ্ছে।
৫. সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের প্রকল্প ভেস্তে গেছে
বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাতের ইসরায়েলি পরিকল্পনা সফল হয়নি। উল্টে সিরিয়ার ভেতরে এখন গড়ে উঠেছে সরাসরি ইসরায়েলবিরোধী জাতীয় প্রতিরোধ ফ্রন্ট।
৬. গাজায় প্রতিরোধ ভেঙে পড়েনি—বরং শক্তিশালী হচ্ছে
হামাসের আল-কাসসাম ব্রিগেড ও ইসলামিক জিহাদের সরায়া আল-কুদস এখনো সক্রিয় এবং কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হচ্ছে। ইসরায়েলের হামলা প্রতিরোধ ধ্বংস করতে পারেনি।
৭. দীর্ঘ যুদ্ধেও প্রতিরোধের ‘মানবশক্তি ও অস্ত্র’ আরও বেড়েছে
বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকেও প্রতিরোধ যোদ্ধারা রকেট নিক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে। “ইয়াসিন” অ্যান্টি-ট্যাংক রকেট এখনো ইসরায়েলি সাঁজোয়া যানকে আঘাত করছে। ধ্বংস নয়, বরং যুদ্ধ প্রতিরোধশক্তিকে আরও বিস্তৃত করেছে।
এরপর কী হবে? যুদ্ধবিরতির পরও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
আবদুলবারি আতওয়ান প্রশ্ন তুলেছেন—বন্দি বিনিময়ের পর কি দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপ আসবে? ট্রাম্প কি নোবেল পুরস্কার না পেলেও রাজনৈতিক লাভের জন্য সমঝোতা চালিয়ে যাবে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত লক্ষ্য প্রতিরোধকে নিরস্ত্র করা—এটা আদৌ সম্ভব?
তার মতে, এখনই এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়—প্রতিরোধ এখনো শেষ হয়নি, বরং তা পশ্চিম তীরে ছড়িয়ে পড়বে এবং ইয়েমেন যেভাবে গাজাকে সমর্থন দিয়েছে, তা অন্য ফ্রন্টেও পুনরাবৃত্তি হবে।
এই যুদ্ধবিরতি সংকটের সমাধান নয়, বরং পরবর্তী বড় পর্যায়ের সূচনা। প্রকৃত ফলাফল নির্ধারিত হবে ভবিষ্যতের ঘটনাবলীতে—আর একটি ব্যাপার পরিষ্কার: মাঠে প্রতিরোধের সমাপ্তি এখনো অনেক দূরে।



