দোয়া কবুল না হওয়ার দশটি কারণ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মানুষ দোয়া করে, চোখের পানি ঝরায়, মোনাজাত করে—তবুও অনেক সময় তার প্রার্থনা পূরণ হয় না। কেন? দোয়ার মালিক নিজেই তো বলেছেন:
ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ—
তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। (সূরা গাফির ৪০:৬০)
এই ঐশী প্রতিশ্রুতির পরও দোয়া কবুল না হওয়ার রহস্য কী? আয়াতুল্লাহ মুজতাহেদি তেহরানী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি বাণী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তুলে ধরেছেন সেই দশটি আধ্যাত্মিক রোগ, যা মানুষের হৃদয়কে কঠিন করে দেয় এবং দোয়া কবুলের দরজাকে বন্ধ করে দেয়। এ দশটি দোষ শুধু আচরণের ত্রুটি নয়—এগুলো আত্মার উপর কালো পর্দা, যা মানুষকে ঈমানী আলো থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
মাওয়ায়েজ আল-আদাদিয়্যা গ্রন্থে বর্ণিত আছে— একদিন সাহাবায়ে কিরাম রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে নিবেদন করলেন: হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ নিজেই তো বলেছেন—ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ অর্থাৎ, ‘আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের আহ্বানে সাড়া দেব।’
তাহলে আমরা তো দোয়া করি—কখনো নিভৃত একাকী প্রার্থনায়, কখনো সমবেতভাবে হৃদয়ের আর্তি উজাড় করে। তবুও কেন আমাদের দোয়া আসমানের দরজায় পৌঁছায় না, কেন তার কবুলের আলো আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হয় না? রাসুলুল্লাহ (সা.) গভীর সত্য প্রকাশ করে বললেন: তোমাদের হৃদয় দশটি কারণে মৃত হয়ে গেছে; তাই তোমাদের দোয়া আর আকাশে উঠে যায় না।
এরপর তিনি একে একে দশটি আধ্যাত্মিক অসুস্থতার কথা তুলে ধরেন—
১. আল্লাহকে জানা, কিন্তু তাঁর আনুগত্য না করা
“عَرَفْتُمُ اللهَ وَ لَمْ تُطِيعُوهُ”
তোমরা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করো, তাঁর জ্ঞান, শক্তি, রহমত সবই স্বীকার করো; কিন্তু তাঁর আদেশ পালন করো না। মানুষ অনেক সময় ভাবে— আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, মাঝে মাঝে দান-সদকা দিই—আমার তো সমস্যা নেই।
কিন্তু আল্লাহ শুধু কিছু ইবাদত চাননি; তিনি চেয়েছেন সম্পূর্ণ আনুগত্য, হৃদয়ের নিয়ন্ত্রণ, নফসের সংশোধন। সামান্য আজ্ঞাভঙ্গও দোয়ার প্রভাব কমিয়ে দেয়।
২. কুরআন পাঠ করা, কিন্তু তার ওপর আমল না করা
“قَرَأْتُمُ الْقُرْآنَ وَ لَمْ تَعْمَلُوا بِهِ”
তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কিন্তু তার আলো আচরণে প্রতিফলিত হয় না।
আল্লাহ হজের নির্দেশ দিয়েছেন—
وَلِلّٰهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
যার সামর্থ্য আছে, তার ওপর আল্লাহর ঘরের হজ ফরজ। —সূরা আলে ইমরান ৩:৯৭ আবার তিনি বলেছেন—
إِنَّ اللّٰهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَআল্লাহ সৎকর্মীদের প্রতিফল নষ্ট করেন না। —সূরা হুদ ১১:১১৫ কিন্তু মানুষ কুরআন পড়ে, তবুও গিবত, মিথ্যা, প্রতারণা, হিংসা—এসব থেকে বিরত হয় না। যখন কুরআন শুধু জিহ্বায় থাকে, জীবনে থাকে না—দোয়া দুর্বল হয়ে যায়।
৩. রাসুলের প্রেমের দাবি করা, কিন্তু তাঁর আহলুল বাইতের প্রতি বিরাগ পোষণ করা
“ادَّعَيْتُمْ مَحَبَّةَ الرَّسُولِ وَ عَادَيْتُمْ عِتْرَتَهُ وَ أَوْلَادَهُ”
নবীপ্রেম মুখে বলা সহজ, কিন্তু তাঁর পরিবারকে সম্মান না করা সেই প্রেমের সাথে প্রতারণা। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আহলুল বাইত তাঁর আলো এবং তাঁর আমানত। তাদের প্রতি বিদ্বেষ ঈমানের কঠিন রোগ।
৪. শয়তানকে শত্রু বলা, কিন্তু তার সাথেই সঙ্গ দেয়া
“ادَّعَيْتُمْ عَدَاوَةَ الشَّيْطَانِ وَ وَافَقْتُمُوهُ”
মুখে বলো—“শয়তান আমাদের শত্রু”— কিন্তু রাগ, ঘৃণা, অহংকার, লোভ, হিংসা—এসবের মাধ্যমে তাকে সঙ্গ দাও। আত্মপ্রবঞ্চনাই দোয়া কবুলের বড় অন্তরায়।
৫. জান্নাতকে ভালোবাসা, কিন্তু জান্নাতের জন্য কাজ না করা
“ادَّعَيْتُمْ مَحَبَّةَ الْجَنَّةِ وَ لَمْ تَعْمَلُوا لَهَا”
মানুষ জান্নাতের বর্ণনা শুনে মুগ্ধ হয়, তার নিয়ামত কামনা করে; কিন্তু জান্নাত অর্জনের জন্য যে নফসকে শোধন করতে হয়—সে কাজ থেকে দূরে থাকে।
কর্মহীন আশা আধ্যাত্মিক অলসতা।
৬. জাহান্নামের ভয় দাবি করা, কিন্তু আগুনের দিকে হাঁটা
“ادَّعَيْتُمْ مَخَافَةَ النَّارِ وَ رَمَيْتُمْ أَنْفُسَكُمْ فِيهَا”
জাহান্নামের ভয়ের কথা মানুষ বলে, কিন্তু সেই কাজগুলোই করে—অন্যায়, গিবত, ব্যভিচার, অত্যাচার—যা নিজেই তাকে আগুনের দিকে ঠেলে দেয়।
৭. অন্যের দোষ খোঁজা, নিজের দোষ ভুলে যাওয়া
“اشْتَغَلْتُمْ بِعُيُوبِ النَّاسِ وَ تَرَكْتُمْ عُيُوبَ أَنْفُسِكُمْ”
নিজের হৃদয়ের অন্ধকার না দেখে, মানুষের ত্রুটি নিয়ে বিচার করা—এটাই দোয়ার শক্তিকে নষ্ট করে দেয়। হাদিসে আছে— সৌভাগ্য তার, যে নিজ ত্রুটির সংশোধনে ব্যস্ত থাকে।
৮. দুনিয়াকে নিন্দা করা, কিন্তু দুনিয়াই সঞ্চয় করা
“ادَّعَيْتُمْ بُغْضَ الدُّنْيَا وَ جَمَعْتُمُوهَا”
মুখে দুনিয়ার নিন্দা, কিন্তু বাস্তবে দুনিয়ার পেছনে দৌড়—এ দ্বিচারিতা হৃদয়ে পর্দা তৈরি করে। দুনিয়া নিজে খারাপ নয়; খারাপ হয় যখন তা হৃদয়ের মালিক হয়ে যায়।
৯. মৃত্যুকে সত্য বলা, কিন্তু তার প্রস্তুতি না নেওয়া
“أَقْرَرْتُمْ بِالْمَوْتِ وَ لَمْ تَسْتَعِدُّوا لَهُ”
মৃত্যু যে অবশ্যম্ভাবী তা সবাই জানে; কিন্তু খুব কম মানুষ মৃত্যুর পরের যাত্রার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। যে মৃত্যুর কথা ভুলে যায়, তার দোয়া হৃদয়ের গভীরতা হারায়।
১০. মৃতদের দাফন করা, কিন্তু শিক্ষাগ্রহণ না করা
“دَفَنْتُمُ الْمَوْتَى وَ لَمْ تَعْتَبِرُوا”
প্রতিদিন কবরস্থান দেখা, লাশ দাফন করা—সবই হয়; কিন্তু আত্মার মধ্যে মৃত্যু-স্মৃতি জাগে না। মৃত্যুর স্মরণ হৃদয়কে নম্র করে, আর নম্র হৃদয়ের দোয়া দ্রুত কবুল হয়।
উপসংহার
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী আমাদের শেখায়— দোয়া শুধু শব্দ নয়; দোয়া হলো হৃদয়ের অবস্থা। একটি পরিচ্ছন্ন, নম্র, খাঁটি ও আল্লাহমুখী হৃদয় থেকে ওঠা দোয়াই আর্শে পৌঁছায়। এই দশটি দোষ ত্যাগ করে মানুষ যদি আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, তবে আল্লাহর দরবারে দোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় না।



