বিশ্বকুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদসংবাদ বিশ্লেষণ

গীবতের পাপ ও মুক্তির পথ: জবানকে পরিশুদ্ধ করার চারটি ধাপ

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৮ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: মানুষের জিহ্বা, আল্লাহর এক অপূর্ব দান—যার মাধ্যমে সে কথা বলে, জ্ঞান প্রকাশ করে এবং সম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু এই আশীর্বাদই অনেক সময় হয়ে ওঠে ভয়াবহ অভিশাপ, যখন তা অন্যের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকারে আঘাত হানে। গীবত—অর্থাৎ কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষগুণ আলোচনা করা—ইসলাম অনুযায়ী এক ভয়ানক গুনাহ, যা হৃদয়ে কালিমা ছড়িয়ে দেয় এবং সমাজে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের জন্ম দেয়।

গীবত এমন এক পাপ, যা অনেক সময় অজান্তেই মানুষের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, অথচ এর পরিণতি এতই কঠিন যে, কুরআন ও হাদীসে একে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইসলাম শুধু গীবতকে নিষিদ্ধ করেনি, বরং এর ক্ষতিপূরণ ও আত্মশুদ্ধির জন্য স্পষ্ট দিকনির্দেশনাও দিয়েছে।

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রেজা মুহাম্মাদি শাহরূদি এক ধর্মীয় আলোচনায় গীবতের মাধ্যমে অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে কীভাবে তা পূরণ করা যায়”— এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চারটি ধাপের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।

প্রথম ধাপ: আন্তরিক তাওবা (অনুতাপ প্রত্যাবর্তন)

গীবত থেকে মুক্তির সূচনা হয় সত্যিকার তাওবা থেকে। কেবল মুখে তাওবা নয়, অন্তর থেকে অনুশোচনা এবং পুনরায় না করার দৃঢ় সংকল্পই প্রকৃত তাওবা।
হাদীসে এসেছে, “যে গীবত করে, সে প্রথমেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে, আর যে তাওবা করে, সে হবে সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশকারী।”
অর্থাৎ তাওবা ছাড়া এই পাপের বোঝা হালকা হয় না।

 দ্বিতীয় ধাপ: গীবতের ক্ষতি পূরণ করা (প্রভাব নিরসন)

গীবতের ফল অনেক সময় অন্যের সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক সম্পর্ক, এমনকি অর্থনৈতিক অবস্থাকেও প্রভাবিত করে। যেমন, কারও সম্পর্কে ভুল বা নেতিবাচক কথা বললে যদি তার প্রতি কারও দৃষ্টিভঙ্গি নষ্ট হয়, তবে গীবতকারীকে সেই ব্যক্তির গুণাবলী, সদাচরণ ও সুনাম প্রকাশ করতে হবে, যেন তার অবস্থান পুনরুদ্ধার হয়।
এই ধাপের মূল লক্ষ্য হলো — যার ক্ষতি হয়েছে, তার মান ফিরিয়ে দেওয়া।

 তৃতীয় ধাপ: গীবতের শিকার ব্যক্তির জন্য নেক আমল করা

যে ব্যক্তির গীবত করা হয়েছে, তার জন্য নফল নামাজ, সদকা বা অন্য কোনো সৎকর্ম সম্পাদন করা— এটি গীবতের ক্ষতিপূরণের এক নরম অথচ গভীর পন্থা।
যখন গীবতের শিকার ব্যক্তি জানবে যে, কেউ তার জন্য দোয়া করেছে বা কল্যাণকর কাজ করেছে, তখন তার হৃদয়ে প্রশান্তি জন্ম নেবে এবং তার অধিকার আংশিক পূরণ হবে। এই ধাপটি আত্মার পরিশুদ্ধি ও পারস্পরিক সহমর্মিতার প্রতীক।

 চতুর্থ ধাপ: ক্ষমা চাওয়া হালাল করে নেওয়া

যদি গীবতের কথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কানে পৌঁছে যায় এবং তার মনে কষ্ট বা ঘৃণা সৃষ্টি হয়, তবে সরাসরি তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া এবং হালাল করে নেওয়া উচিত।
তবে, যদি গীবতের কথা সে না জেনে থাকে এবং ক্ষমা চাইলে উল্টো সমস্যা সৃষ্টি হয়— যেমন, নতুনভাবে মনোমালিন্য বা সন্দেহ— তবে নীরব থাকা ও অন্য পথে প্রায়শ্চিত্ত করা উত্তম।
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমা চাওয়া শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি আত্মনম্রতা ও নৈতিক পুনর্জন্মের প্রতীক।

 উপসংহার:

গীবতের পাপ শুধু মুখের নয়—এটি আত্মার রোগ, যা অন্যের মর্যাদা ধ্বংসের পাশাপাশি নিজের পরকালও বিপন্ন করে। তাই এর প্রতিকারও কেবল মুখের নয়, বরং হৃদয়ের তাওবা, কর্মের সংশোধন ও সম্পর্কের পুনর্গঠন প্রয়োজন।

এই চারটি ধাপ—
১. তাওবা ও অনুশোচনা,
২. ক্ষতি পূরণ,
৩. সৎকর্ম সম্পাদন,
৪. এবং ক্ষমা প্রার্থনা—
একসঙ্গে গীবতের পরিশুদ্ধির সম্পূর্ণ পথ রচনা করে। পাশাপাশি, নিজ ও গীবতের শিকার ব্যক্তির জন্য ইস্তেগফার (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া) করা— আল্লাহর রহমত লাভের অন্যতম উপায়।

আল্লাহ বলেন:

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ

যারা কোনো অশ্লীলতা করে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করে, তারা সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা চায়।” (সূরা আলে ইমরান, ১৩৫)

অতএব, গীবতের মুক্তি শুধু মুখ বন্ধ রাখায় নয়—বরং হৃদয়, আমল ও সম্পর্কের এক সমন্বিত পরিশুদ্ধিতে নিহিত। যে তার জবানকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে কেবল নিজের নয়—পুরো সমাজের শান্তির পথ রচনা করে।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button