হিজবুল্লাহর সামরিক মস্তিষ্ক কে ছিলেন?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন । প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির:গত বছর প্রতিরোধের ইতিহাসে এক ঘটনাবহুল বছর কেটেছে—লেবাননে সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহর অবিশ্বাস্য শহীদ হওয়া থেকে শুরু করে “ওয়াদে সাদেক” (সত্য প্রতিশ্রুতি) অভিযান এবং ইরানে ১২ দিনের যুদ্ধ পর্যন্ত। এ সময়ে ইসলামের জন্য এমন সব শহীদ আত্মোৎসর্গ করেছেন, যাদের প্রত্যেককে ঘিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যায় এবং বই লেখা যায়। এমন শহীদরা, যারা বহু বছর সম্পূর্ণ গোপনীয়তায় এমন সব কাজ করেছেন যে শত্রুরা অবাক হয়ে গিয়েছিল—কীভাবে এত অল্প সম্পদ আর আন্তর্জাতিক অবরোধের চাপ সত্ত্বেও এভাবে দৃঢ় প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো!
“শহীদ ইব্রাহিম আকিল”, যার জিহাদি নাম ছিল হাজ আবদুলকাদির, ছিলেন এমনই এক মুজাহিদ। বহু বছর তিনি লেবাননে হিজবুল্লাহর রিদওয়ান ইউনিট এর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং জটিল অভিযানের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন। তিনি শহীদ ইমাদ মুগনিয়া ও হাজ আলি কারাকির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা ছিলেন। গত বছর ঠিক এই দিনে ইসরায়েলের হাতে তিনি শহীদ হন।
এই শহীদের কন্যা জেইনাব আকিল এ উপলক্ষে তাসনিমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁর বাবার জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন। প্রথম হাতের এই বর্ণনাগুলো অনেকটা হলেও হিজবুল্লাহর এই অখ্যাত কমান্ডারকে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর যদি না থাকতেন লেবাননের সাংবাদিক আমল শাবিব, যিনি নিজেও প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি অনুরাগী, তবে হয়তো এই লেখাটি সম্পূর্ণ হতো না।
প্রতিরোধ আমাদের ভেতরে প্রোথিত ছিল
আমি এমন এক ঘরে বড় হয়েছি, যেখানে প্রতিরোধ ও তার প্রতি অঙ্গীকার আমাদের জীবনে খুঁটিনাটি সহকারে প্রোথিত ছিল। প্রতিরোধ মানে কেবল সামরিক বিকল্প নয়, বরং এক ধরনের সংস্কৃতি ও শিক্ষামূলক আচরণ, যা আমাদের সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যেও প্রতিফলিত হতো—ধৈর্য, শৃঙ্খলা, অন্যের প্রতি সম্মান এবং এই বিশ্বাস যে মর্যাদা কেনা যায় না। আর এই অবিচারপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থায় শাসন ও অধিকার শক্তি দিয়েই অর্জন করতে হয়।
বাবার সামরিক ধারণা ও বাস্তবতার সমন্বয়
আমার বাবা ইব্রাহিম আকিল—যাকে তাঁর জিহাদি নাম হাজ আবদুলকাদির নামে সবাই চিনতেন—খুব অল্প বয়সেই নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সামরিক অভিযানের দায়িত্ব নেন। তখন তিনি লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনের সামরিক শাখায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি আনেন। তিনি সামরিক ধারণাগুলোকে সে সময়কার বাস্তব অবস্থা ও সীমিত সম্পদের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে সক্ষম হন। এর ফলেই ধীরে ধীরে এমন অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল যা শত্রুকে সম্পূর্ণ বিস্মিত করত, বিশেষ করে যখন ভেতরে গুপ্তচরও ছিল। এই অভিযানগুলো দ্রুত সম্পন্ন হতো, খুব কম সময়ে সরঞ্জাম স্থানান্তরিত ও প্রস্তুত করা হতো এবং পূর্ণ নিরাপত্তায় সফলভাবে শেষ করা যেত। এসব কারণে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে শত্রু প্রভাবিত হতো এবং হতবাক হয়ে ভাবত: এই আগুন কোথা থেকে আসছে? কারণ হাতে গোনা কয়েকজন যুবক, বিশেষ অস্ত্র ছাড়াই, খালি হাতে তাদের পূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হতো।
ইব্রাহিম হিজবুল্লাহর সামরিক মস্তিষ্ক
হাজ আবদুলকাদিরের মতো কমান্ডারদের কর্মকাণ্ডের ফলেই একের পর এক অভিযান শুরু হয়েছিল—যেমন “সাজেদ” অভিযান, “আল-বিয়াদাহ” অভিযান, “বেইত ইয়াহুন” অভিযান এবং “জাজিন” ঘাঁটিতে হামলা। এগুলো বাবার সৃজনশীল পরিকল্পনার ফল। শুনেছি, লেবাননের প্রতিরোধের কিংবদন্তি শহীদ ইমাদ মুগনিয়া বলেছিলেন: “ইব্রাহিম হলো হিজবুল্লাহর সামরিক মস্তিষ্ক।”
তাদের এসব অভিযানের ফলে দক্ষিণাঞ্চলে দখলদার ইসরায়েলি সেনারা কার্যত পঙ্গু অবস্থায় পৌঁছে যায়। এতটাই সফল হয়েছিলেন হাজ আকিল যে, ২০০০ সালের বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে শত্রুরা ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় তাঁকে হত্যা করার, যাতে প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং দক্ষিণ লেবানন পুনরায় দখলে নেওয়া যায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা শত্রুর ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয় এবং তিনি বেঁচে যান—যতক্ষণ না ২৫ বছর পর এক ঐশী দিনে তিনি শাহাদাতের আনন্দ উদযাপন করেন।
আমরা খুব শিগগিরই বুঝেছিলাম বাবা সাধারণ মানুষ নন
শৈশবে, বয়স খুব কম হলেও আমি ঘরে সতর্কতা ও সুরক্ষার পরিবেশ স্পষ্টভাবে অনুভব করতাম। বাবার চলাফেরা ছিল সীমিত, তিনি খেয়াল রাখতেন কোথাও যেন ছবি না তোলা হয় ইত্যাদি। আমরা খুব দ্রুত বুঝেছিলাম, আমাদের বাবা সাধারণ মানুষ নন; তাঁর ব্যাপারে সামান্য অবহেলাও বড় মূল্য ডেকে আনতে পারে। তবে হাজ ইব্রাহিমের শক্তির গোপন রহস্য ছিল তাঁর বিনয় আর দক্ষতা। তিনি যা করতেন সব গোপনে করতেন, কখনো প্রচার পছন্দ করতেন না। তিনি জীবন কাটিয়েছেন সাদাসিধে, তৃপ্ত আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে থেকে। তাঁর চারপাশে তিনি তৈরি করেছিলেন সরলতা, অঙ্গীকার আর নিরাপত্তামূলক শৃঙ্খলার এক প্রাচীর। শত্রুরা তাঁকে “ভূত” বলত, কারণ তাঁর ছায়া পর্যন্ত তাদের নিজেদের থেকেও বেশি আতঙ্কিত করত।
তরুণ বয়সেই লেবাননের বোঝা বহন করেছিলেন প্রতিরোধের মুজাহিদরা
শহীদ সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ, হাজী আলি কারাকি, আমার বাবা এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যান্য কমান্ডার ও শহীদরা একটি মহৎ লক্ষ্যের পথে একত্রিত হয়েছিলেন। তাদের সম্পর্ক কেবল কাজের সহযোগিতা ছিল না, বরং একসঙ্গে পথচলা ও অস্ত্রের সঙ্গী হওয়া ছিল। তারা আশির দশকের শুরুতে, যখন সবাই তরুণ এবং প্রায় সমবয়সী, তখন প্রতিরোধ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এত অল্প বয়সেই তারা লেবাননের জনগণের দুঃখ-কষ্ট নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং সেই সময় থেকেই এমন মনোবল ধারণ করেছিলেন যে বলা যায়, তারা তখনও জীবিত শহীদ ছিলেন। হিজবুল্লাহর শহীদরা ছিলেন মহৎ ব্যক্তিত্ব। যেমন—আমার বাবা যখন তাঁর সহযোদ্ধা শহীদ হাজ ইমাদ সম্পর্কে বলতেন, বলতেন: “তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মস্তিষ্ক এবং সত্যিই এক অখ্যাত মুজাহিদ, যার সৃজনশীলতা ও পরিকল্পনা করার ক্ষমতা ছিল বিরল।” অবশ্য বাবার হৃদয়ে শহীদ মুগনিয়ার মর্যাদা তাঁর বলা কথার থেকেও অনেক বড় ছিল।
তিনি আরও বলতেন, সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ লেবানন জাতির জাগ্রত বিবেক। তাঁর নেতৃত্ব সময় ও স্থানের ঊর্ধ্বে, আর মুজাহিদদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল এমন আবেগময়—যেমন ইয়াকুবের সঙ্গে ইউসুফের সম্পর্ক। তিনি রণাঙ্গনের সহযোদ্ধাদের নিজের রক্তের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। বাবা সবসময় জোর দিয়ে বলতেন, সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহ আল্লাহর অনুমোদিত নেতা, আর তাঁর মতামত প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতিটি ভাগ্যনির্ধারক সিদ্ধান্তের মানদণ্ড ছিল। আমি মনে করি, তাঁরা সবাই তাঁদের বিশেষ আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে যাত্রা করেছিলেন।
আমরা বাবার মধ্যে এক সুন্দর দ্বৈততা দেখেছি
আমার বাবা দুনিয়াবি বিষয় ও পদমর্যাদার প্রতি খুবই বিনয়ী ও নির্লিপ্ত ছিলেন। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যই ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার। তাঁর নামাজ আর তাহাজ্জুদ আমার স্মৃতি থেকে কখনো মুছে যাবে না। মনে পড়ে, আমি ফজরের আজানের আগে জেগে উঠতাম আর তাঁকে সিজদায় বা নামাজে দেখতে পেতাম। যখন বুঝতেন আমি জেগে আছি, তখন আমাকে স্নেহভরে বুকে জড়িয়ে নিতেন। সংবেদনশীল পদে থাকা সত্ত্বেও আমরা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হইনি। তিনি আমাদের খুব কাছে ছিলেন, জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে অংশ নিতেন, কিন্তু একই সময়ে অনুভব করতাম তাঁর হৃদয় সর্বদা যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে বাঁধা। আমার বাবা সত্যিই ইমাম খোমেনি (রহ.) এবং ইসলামে নিজেকে বিলীন করেছিলেন।
আমরা বাবার মধ্যে এক সুন্দর দ্বৈত অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম—একজন স্নেহময় পিতা, যিনি আমাদের সঙ্গে মজা করতেন, পড়াশোনার দিকে নজর দিতেন; আর একই সঙ্গে একজন নীরব কমান্ডার, যার চোখে প্রতিরোধ আন্দোলনের দায়িত্ব ও চিন্তা স্পষ্ট প্রতিফলিত হতো। তিনি আমাদের মধ্যে সর্বাগ্রে দায়িত্বশীলতা আর প্রতিরোধে আত্মনিবেদনের মূল্যবোধ গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন। আমাদের শিক্ষায় তিনি সবার আগে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর জোর দিতেন—যা অবশ্যই কুরআনের মাধ্যমে স্থাপিত হওয়া উচিত। তাঁকে “কুরআনিক কমান্ডার” বলা হতো, কারণ তিনি জীবনের সব দিক, এমনকি সামরিক সিদ্ধান্তও কুরআন থেকে গ্রহণ করতেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন—জ্ঞানই আমাদের দ্বিতীয় অস্ত্র, এবং সংস্কৃতি ও বিদ্যা কোনোভাবেই বন্দুকের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজ আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো, বাবার জীবনের জন্য উৎসর্গীকৃত মূল্যবোধগুলো রক্ষা করা—যেমন মর্যাদা, ঐক্য, ফিলিস্তিনের প্রতি বিশ্বাস ও মুসতাজআফিনদের (অবহেলিতদের) পক্ষে দাঁড়ানো।
আমার মনে আছে, তিনি আমাদের বারবার শিখিয়েছিলেন কীভাবে দোয়া করতে হয় এবং তাঁর সহজ সরল কুরআনিক-দর্শনীয় জীবনধারা দিয়ে জীবন বোঝাতে চেষ্টা করতেন। তাঁর অনন্য আলিঙ্গন আমার মনে অম্লান—যেখানে স্নেহ, আধ্যাত্মিকতা ও আলো একসঙ্গে মিলেমিশে থাকত। আমার বাবা ছিলেন এক আধ্যাত্মিক মানুষ, যেমন আলেম ও সহকর্মীরা তাঁকে বর্ণনা করতেন। তাঁর ছিল শক্তিশালী ইবাদতের কর্মসূচি, যা তাঁর মতো আরেফদের জন্য উপযুক্ত ছিল এবং তিনি এটিকে নিজের ওপর কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
প্রতিরোধ কোনো স্লোগান নয়, এটি রক্ত ও আত্মত্যাগের পথ
হাজী ইব্রাহিম আকিল আমাকে বলেছিলেন তাঁর চিন্তাধারা পৌঁছে দিতে—তাঁর পুরো জীবনই ছিল এক ধরনের ওসিয়াত। আমি চেষ্টা করব তিনি আমাকে যে উপকরণ দিয়েছেন তা কাজে লাগাতে: রাজনৈতিক ও সামাজিক নীতিমালা এই প্রতিরোধের ইতিহাসের সংবেদনশীল পর্যায়ে, এবং আমার পেশাগত দক্ষতা—লেখা, গবেষণা, প্রেরণাদায়ক বক্তব্য, এবং যেখানে যুদ্ধ আহ্বান করে সেখানে উপস্থিত থেকে—কার্যকর ভূমিকা রাখতে। বাবার শাহাদাত এবং তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তা ও সামরিক ঐতিহ্য আমার জন্য একটি জীবন্ত দায়িত্ব, কেবলমাত্র স্মৃতি নয়। তিনি বলতেন: “আমাদের এই আমানত রক্ষা করতে হবে এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের হাতে পৌঁছে দিতে হবে।” বিদায়ের সেই মুহূর্ত আমার হৃদয়ে অমর হয়ে আছে। তিনি তাঁর স্বপ্ন পূর্ণ করেছেন, কিন্তু আমার পুরো পৃথিবীকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছেন।তাঁর রেখে যাওয়া ভিডিও ও বক্তৃতাগুলো আমার কাছে জীবন্ত স্মৃতি। প্রতিটি শব্দ তাঁর চিন্তা প্রতিফলিত করে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয়: প্রতিরোধ কোনো স্লোগান নয়, এটি রক্ত ও আত্মত্যাগের পথ।
আহ, যদি আর একবার ফিরে আসতেন, তাঁকে আলিঙ্গন করতাম
শাহাদাতের কয়েক দিন আগে শেষবার তাঁকে দেখেছিলাম। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শান্ত ছিলেন, তাঁর মুখ আলোয় ভরে ছিল এবং শহীদদের বৈশিষ্ট্য তাতে প্রতিফলিত হচ্ছিল। তিনি গোপনে, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আমার বাড়িতে এসেছিলেন। বলেছিলেন: “শত্রুরা যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে (কমান্ডারদের টার্গেট করছে এবং আমি তাদের প্রধান লক্ষ্যগুলির একজন), তবু আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম।”
আমার অভ্যাস ছিল প্রতি রবিবার তাঁর জন্য রাতের খাবার তৈরি করা, কারণ সাধারণত তখনই তাঁকে দেখা হতো। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করে ও দ্রুত এসে পড়লেন। আমি তাঁর জন্য সামান্য আলু আর দই তৈরি করেছিলাম। তিনি ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত ছিলেন, কিন্তু জোর দিয়ে বললেন: “আমি অবশ্যই তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম।”
আমি কখনো ভুলতে পারব না সেই শেষ সাক্ষাৎ, শেষ আলিঙ্গন আর তাঁর মুখের শেষ অভিব্যক্তি। আহ, যদি আর একবার ফিরে আসতেন, তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরতাম, তারপর যেতেন। তাঁকে বলতে চাইতাম—তোমার শাহাদাত আমার হৃদয়ে এমন এক আগুন জ্বালিয়েছে যা কখনো নিভবে না। এটি সেই আগুন, যে ক্ষতির তাপে আমি পুড়ছি—একজন পুরুষের ক্ষতি, যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইসলাম ও উম্মাহর সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন। আমি তাঁর চিন্তা ও উত্তরাধিকার বহন করব এবং কখনো মরতে দেব না।
হাজী ইব্রাহিম আকিল—আমাদের বাবা—যাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা আমরা অনুভব করেছিলাম, কিন্তু তাঁর জিহাদি সত্তা হাজী আবদুলকাদির এক স্থায়ী প্রতীক হয়ে থাকবে। আমরা তাঁর রেখে যাওয়া কাজের মাধ্যমেই তাঁকে জানার চেষ্টা করব। বাবা কখনো আমাদের কাছে তাঁর অভিযান বা কীভাবে সেগুলো পরিচালিত হতো তা বলতেন না; তিনি ছিলেন গোপনীয়তার রক্ষক। আমরা তাঁর শহীদ হওয়ার আগে কিছুই জানতাম না, কেবল দেখতাম শত্রুরা তাঁকে নিয়ে কী লিখছে এবং বুঝতাম কতটা তিনি ইসরায়েলিদের বিপদে ফেলেছিলেন ও ক্লান্ত করে তুলেছিলেন।
বাবা অপেশাদারী আত্মত্যাগী অভিযানের শিখর দেখতেন
আমার বাবা আত্মত্যাগীদের সর্বোচ্চ বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচালিত অপেশাদারী অভিযানকে প্রতিরোধের শীর্ষ কৌশল মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এটি এমন একটি সমীকরণ যা কেবলমাত্র সেই ব্যক্তি বুঝতে পারে, যিনি বিশ্বাস করেন যে মাতৃভূমি জীবনের চেয়ে মূল্যবান। তিনি দেখতেন, তারা প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রাথমিক দিনে মানসম্মত একটি গুণগত উত্থান। বিশেষভাবে, হামদ কাসিরের আত্মত্যাগী অভিযান দক্ষিণ লেবাননের নৌসেনা ঘাঁটি ও মোসাদের কেন্দ্রে এই ধারণাগুলো আরও জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।
ফিলিস্তিন বাবার দৈনন্দিন জীবনের দিকনির্দেশক ছিল
ফিলিস্তিন আমার বাবার দৈনন্দিন আচরণ ও কথোপকথনে একটি কম্পাসের মতো ছিল। দক্ষিণ লেবাননে সহায়তা ফ্রন্ট খোলার পরে, প্রতিরোধের শাখায় ক্ষতি সত্ত্বেও তিনি বলতেন:যদি সময় ফিরে যায়, আমরা আবারও এটি করব, কারণ আমরা শত্রুর এই হত্যাযজ্ঞ এবং বর্বর আচরণ আমাদের ভাইদের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।”
এটি তাঁর জন্য একটি আধ্যাত্মিক ও মানবিক দায়িত্ব ছিল। তিনি আরও বলতেন, আমরা যেখানে থাকা উচিত সেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা, সংকল্প ও স্থিতিশীলতা নিয়ে থাকব। এবং যদি একজন বেঁচে থাকে, আমরা পথ চালিয়ে যাব যতক্ষণ না আল্লাহ সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করবেন।
বাবার শাহাদাত আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটেছে
হাজী আকিল সবসময় শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। বাস্তবে, যখন আমরা তাঁর শাহাদাতের খবর শুনলাম, আমরা অবাক হইনি, কারণ আমরা সবসময় অনুভব করতাম, যদি তিনি এখনও জীবিত থাকেন, তবে সময় আরও পিছিয়ে গেছে যাতে তিনি আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারেন। ইব্রাহিম আকিল তখন শাহাদাত বরণ করেন যখন আল্লাহ তাঁকে নিজের দিকে ডাকলেন, শত্রুর হত্যার পরিকল্পনার আগে নয়।
প্রতিরোধ কেবল একটি দেশের প্রকল্প নয়
প্রতিরোধ কেবল কোনো দেশের জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প নয়। এটি সমস্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি পথ, যাদের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। একই সঙ্গে, ইসরায়েলি শত্রুরও সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ইনশাআল্লাহ, বিজয়—যদিও মূল্য অত্যন্ত বেশি হোক—সারা উম্মাহর স্তরে ঘাতক ও দখলদার শাসনপদ্ধতির পতনের মাধ্যমে হবে। এই উম্মাহ শহীদ এবং নেতৃত্বের জন্ম দিতে থাকবে যতক্ষণ না আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়।
হাজী আকিল—এক প্রজন্মের পিতা
হাজী আকিল কেবল আমাদের বাবা ছিলেন না, তিনি পুরো প্রতিরোধী প্রজন্মের পিতা। তিনি সর্বদা জোর দিতেন যে, সেই সমস্ত যোদ্ধারা তাঁর সন্তান। তাঁর উপস্থিতি আমাদের মধ্যে অব্যাহত রয়েছে এবং তাঁর উষ্ণতা কখনো নিভবে না। বরং এটি একটি সংরক্ষিত শক্তি হয়ে থাকবে, যা প্রতিশোধের জন্য থাকবে, প্রতিটি শহীদের মায়ের চোখে, যারা তাদের সন্তানদের গল্প বাবার গল্পে দেখেন।