আখেরি জামানায় ইবলিসের আবির্ভাব ও হকের সেনাদের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন| ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির তাসনিম সংবাদ সংস্থা, সাঈদ শিরি আখেরি জামানার ঘটনাবলি জানা প্রতিটি মু’মিন মুসলমানের জন্য এক অপরিহার্য দায়িত্ব। যে ব্যক্তি ঈমান ও গভীর প্রজ্ঞাতের আলোকে নিজেকে প্রস্তুত করতে চায় মানবজাতির ইতিহাসের সর্ববৃহৎ পরিবর্তনের জন্য, তার জন্য এসব বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক। নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতের আলোকে এই ঘটনাবলির সঠিক উপলব্ধি মানুষকে বিভ্রান্তির ফাঁদ থেকে রক্ষা করে এবং তাকে সর্বদা হকের ময়দানে অটল রাখে।
শিয়া রেওয়ায়েতের দৃষ্টিতে আখেরি জামানা কেবল এক অশান্ত সময় নয়; বরং এটি আল্লাহর আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং হকের উপর বাতিলের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বাইতের হাদিসসমূহে আখেরি জামানার সূক্ষ্মতম চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সেখানে মূল চরিত্রদের পরিচয় যেমন—ইমাম মাহদি (আ.), ইমামদের রাজআত এবং শত্রু ইবলিস—স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
কুরআনের দৃষ্টিতে ইবলিস ও তার মেয়াদ
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তা‘আলা ইবলিসের বহিষ্কারের কাহিনি উল্লেখ করেছেন। ইবলিস প্রার্থনা করেছিল: “أَنْظِرْنِی إِلَى یَوْمِ یُبْعَثُونَ” (আ‘রাফ: ১৪) অর্থাৎ, আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিন। কিন্তু আল্লাহর জওয়াব ছিল: “إِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ إِلَى یَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ” (হিজর: ৩৭-৩৮) অর্থাৎ, তুমি অবকাশপ্রাপ্ত, তবে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।
ইমাম সাদিক (আ.) ব্যাখ্যা করেছেন যে, এ “ওয়াক্তে মা‘লুম” হলো সেই দিন, যখন ইবলিস চূড়ান্ত যুদ্ধে হকের সেনাদের মুখোমুখি হবে।
আমিরুল মুমিনিনের রাজআত
রেওয়ায়েতে এসেছে, সেই নির্দিষ্ট দিনে আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) তাঁর মুমিন সাথীদের নিয়ে রাজআত করবেন, যাতে দুনিয়াকে ইবলিস ও তার অনুসারীদের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে ইবলিসও তার আদিকাল থেকে শেষ সময় পর্যন্ত সব অনুসারীকে সমবেত করবে। তখন হক ও বাতিলের মধ্যে হবে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ।
রাজআত,(আবার প্রত্যাবর্তন) ঈমানের নিদর্শন
শিয়া চিন্তায় রাজআত হলো কিয়ামতের পূর্বে কিছু খাঁটি মুমিন ও কঠিন কাফেরদের দুনিয়ায় প্রত্যাবর্তন। ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাবের পর এবং কিয়ামতের আগে এই ঘটনা সংঘটিত হবে। মুমিনরা ফিরে আসবে হকের সরকারকে সাহায্য করার জন্য, আর কাফেররা আসবে দুনিয়ায় শাস্তি ভোগ ও অপমানিত হওয়ার জন্য।
ইমামগণ রাজআতকে ঈমানের নিদর্শন বলেছেন। ইমাম সাদিক (আ.) এরশাদ করেছেন: “مَنْ أَقَرَّ بِسَبْعَةِ أَشْيَاءَ فَهُوَ مُؤْمِنٌ”
অর্থাৎ, যে সাতটি বিষয়ে বিশ্বাস করবে, সে মুমিন; এর একটি হলো রাজআতের বিশ্বাস। (ওসাইলুশ শিয়া, খণ্ড ২৪, পৃ. ১৩৩)
যুদ্ধের স্থান ও ভয়াবহতা
রেওয়ায়েত অনুসারে, এ যুদ্ধ সংঘটিত হবে ইরাকের কুফার নিকটে, “আল-রওহা” নামক স্থানে, ফোরাত নদীর তীরে। যুদ্ধের তীব্রতা এতটাই হবে যে, কিছু মুমিন সাহাবি শতধাপ পিছিয়ে যাবে, আবার কারও পা ফোরাতের পানিতে ডুবে যাবে। এটি বাতিল শক্তির শেষ আঁকড়ে ধরা।
তখন কুরআনের এ আয়াত বাস্তবে রূপ নেবে: “فِی ظُلَلٍ مِنَ الْغَمامِ وَ الْمَلائِكَةُ وَ قُضِیَ الْأَمْر” (বাকারা: ২১০)
রাসূলুল্লাহ (সা.) ফেরেশতাদের সঙ্গে নূরের বর্শা হাতে অগ্রভাগে দাঁড়াবেন এবং ইবলিসের ইতিহাসের শেষ অধ্যায় রচনা করবেন।
ইবলিসের ধ্বংস
ইবলিস নবীর চেহারা দেখে আতঙ্কে চিৎকার করবে: “إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ” (আনফাল: ৪৮) অর্থাৎ, আমি এমন কিছু দেখি যা তোমরা দেখ না; আমি আল্লাহকে ভয় করি। কিন্তু তার এ পলায়ন বিফল হবে। নবী করিম (সা.) নূরের বর্শা তার কাঁধের মাঝ বরাবর বিঁধে দেবেন, আর এভাবেই ইবলিস ও তার সমস্ত অনুগামী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
হকের শাসন ও জান্নাতি পৃথিবী
ইবলিসের বিনাশের পর আল্লাহর একত্ববাদী শাসন পুরো দুনিয়াজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমিরুল মুমিনিন (আ.) শাসনভার গ্রহণ করবেন এবং ৪৪ হাজার বছর ধরে ন্যায় ও বরকতে দুনিয়াকে শাসন করবেন। তখন প্রতিটি শিয়া প্রতিবছর একটি করে পুত্রসন্তান লাভ করবে এবং হাজারো সন্তান তার বংশে জন্ম নেবে।
কুফা মসজিদের চারপাশে দুটি সবুজ উদ্যান গড়ে উঠবে, যাকে কুরআনে বলা হয়েছে: “مُدْهَامَّتَان” (রহমান: ৬৪) পৃথিবী জান্নাতের দৃশ্যে পরিণত হবে এবং কুরআন-হাদিসে বর্ণিত অঙ্গীকার গুলি বাস্তব রূপ নেবে।
উপসংহার
এই মহাযুদ্ধ ও বিস্ময়কর ঘটনাবলি যদিও জাগতিক বুদ্ধি দিয়ে অসম্ভব বলে মনে হয়, তবুও এর শেকড় রয়েছে ওহির অবিনশ্বর সত্যে। পশ্চিমা সভ্যতা আজ মিডিয়ার শক্তিতে এসব ধারণাকে বিকৃত রূপে প্রচার করছে—যেখানে হকের নায়করা খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপিত হয় এবং বাতিল শক্তি নায়ক রূপে প্রতিভাত হয়।
অতএব, প্রকৃত মু’মিনের দায়িত্ব হলো মাসুমিনদের নির্ভুল বাণীতে আস্থা রাখা, রাজআত ও আখেরি জামানার ওয়াদা দৃঢ় বিশ্বাস রাখা এবং সর্বদা হকের ময়দানে অবিচল থাকা।
[1] . পাদটীকা
মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন ইবনে আবি খাত্তাব → মূসা ইবনে সা‘দান → আবদুল্লাহ ইবনে কাসিম হাজরামী → আব্দুল কারীম ইবনে আমর খথ‘আমী → থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন: আমি ইমাম সাদিক (আ.)-কে বলতে শুনেছি:
“নিশ্চয়ই ইবলিস বলেছিল: আমাকে অবকাশ দাও কিয়ামত পর্যন্ত, যেদিন মানুষ পুনরুত্থিত হবে (আ‘রাফ: ১৪)। কিন্তু আল্লাহ তা মঞ্জুর করেননি। তিনি বলেন: তুমি মেয়াদপ্রাপ্ত, তবে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (হিজর: ৩৭–৩৮)।
যখন সেই নির্দিষ্ট সময় আসবে, তখন ইবলিস (আল্লাহর অভিশাপ তার উপর) তার সব অনুসারীসহ প্রকাশ পাবে—যতদিন থেকে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন, সেই দিন পর্যন্ত। আর এটিই হবে আমিরুল মুমিনিন (আ.)-এর শেষ রাজআত ।”
আমি আরজ করলাম: “তাহলে কি একাধিক রাজআত আছে?”
তিনি বললেন: “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই রাজআতের পর রাজআত আসবে। কোনো ইমাম নেই যার যুগে তিনি রাজআত করবেন না, এবং তার সাথে নেককার ও পাপী উভয়েই ফিরে আসবে, যতক্ষণ না আল্লাহ তা‘আলা মুমিনকে কাফেরের উপর বিজয় দান করবেন।
যখন ‘ওয়াক্তে মা‘লুম’ উপস্থিত হবে, তখন আমিরুল মুমিনিন (আ.) তার সাথীদের নিয়ে রাজআত করবেন, আর ইবলিসও তার অনুগামীদের নিয়ে আসবে। তাদের প্রতিশ্রুত মিলনস্থল হবে ফোরাত নদীর তীরে, একটি ভূমিতে যার নাম ‘আর-রওহা’, তোমাদের কুফার নিকটে।”
যুদ্ধের বিবরণ
এরপর তিনি বলেন: “তখন তারা এমন এক যুদ্ধে লিপ্ত হবে, যেরূপ যুদ্ধ আল্লাহ বিশ্বজগত সৃষ্টি করার পর থেকে আর কখনো হয়নি। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, আলীর (আ.) সাথীরা পিছিয়ে যাচ্ছে, শত ধাপ পর্যন্ত পিছু হটছে, এমনকি কিছু লোকের পা ফোরাত নদীতে ডুবে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই আল্লাহ তাআলা মহিমার সাথে নেমে আসবেন ‘মেঘের আচ্ছাদনে, ফেরেশতাদের সাথে’, এবং বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।” (বাকারা: ২১০ এর ইঙ্গিত)
রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন সামনে থাকবেন, হাতে থাকবে নূরের বর্শা। যখন ইবলিস তাঁকে দেখবে, সে পিছন ফিরবে, পা টেনে পিছু হটবে। তার অনুসারীরা বলবে: “কোথায় যাচ্ছ, যখন তুমি তো বিজয়ী হয়েছো?”
কিন্তু ইবলিস বলবে: “আমি যা দেখি, তা তোমরা দেখ না। আমি আল্লাহকে, বিশ্বজগতের প্রতিপালককে ভয় করি।” (আনফাল: ৪৮)
তখন নবী করিম (সা.) তাকে ধরে ফেলবেন এবং তার দুই কাঁধের মাঝখানে নূরের বর্শা প্রবেশ করাবেন। সেটাই হবে তার ধ্বংস এবং তার সমস্ত অনুসারীর সমাপ্তি।
পরিণতি
এরপর আল্লাহর ইবাদত হবে, আর কোনো কিছু তাঁর সাথে শরিক করা হবে না। আমিরুল মুমিনিন (আ.) চুয়াল্লিশ হাজার বছর শাসন করবেন। সেই সময়ে আলীর (আ.) একজন শিয়া প্রতিবছর একটি করে পুত্রসন্তান লাভ করবে, এবং তার বংশে এক হাজার সন্তান জন্ম নেবে।
তখন মসজিদে কুফা ও তার চারপাশে দুই বাগান উদ্ভাসিত হবে, যেগুলোকে কুরআনে বলা হয়েছে: “مُدْهَامَّتَانِ” — অর্থাৎ দুই সবুজ উদ্যান, সবুজে গাঢ়, জান্নাতের ন্যায়। (রহমান: ৬৪)