গাল্ফভূক্ত (GCC) দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া: কাতারে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে প্রতিরক্ষা সংহতির নতুন অধ্যায়
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তথ্য আদান-প্রদান ও একীভূত সামরিক কমান্ড
বৈঠকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল একীভূত সামরিক কমান্ডের অধীনে গোয়েন্দা ও সামরিক তথ্য আদান-প্রদান জোরদার করা। এর ফলে GCC দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও কার্যকর হবে এবং সম্ভাব্য হুমকির ক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা বাড়বে। বিশেষত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে যৌথ সতর্কবার্তা ব্যবস্থা দ্রুত সক্রিয় করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
যৌথ মহড়া ও প্রস্তুতি
আগামী তিন মাসের মধ্যে আকাশ প্রতিরক্ষা এবং অপারেশনাল সেন্টারগুলোর মধ্যে যৌথ মহড়া আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর পর একটি পূর্ণাঙ্গ আকাশসেনা মহড়া করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের মহড়া শুধু প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নয়, বরং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সেনাবাহিনীর মধ্যে আস্থা ও সমন্বয় বাড়াতে সহায়ক হবে।
সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একক কণ্ঠে বার্তা
GCC প্রতিরক্ষা পরিষদ কাতারে ইসরায়েলি আগ্রাসনকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের প্রকাশ্য লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। পরিষদ ঘোষণা করেছে— “কাতারের ওপর হামলা মানেই উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সব দেশের ওপর হামলা।”
এটি GCC-এর প্রতিরক্ষা নীতিতে সমষ্টিগত নিরাপত্তার ধারণাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
কাতারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন
বিবৃতিতে কাতারের সরকারকে পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। কাতার নিজের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় যে পদক্ষেপই নিক না কেন, GCC দেশগুলো কাতারের পাশে থাকবে। পরিষদ আরও উল্লেখ করেছে যে, এই হামলা কাতারের মধ্যস্থতায় গাজার যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করেছে।

পটভূমি: GCC প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠার পরপরই GCC সদস্য রাষ্ট্রগুলো যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়—
“যে কোনো সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ মানে গোটা পরিষদের ওপর আক্রমণ।”
২০০০ সালে এই চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করতে অনুমোদিত হয় “যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি” (Joint Defence Agreement)। এর অধীনে গঠিত হয় “পেনিনসুলা শিল্ড ফোর্স”, যা GCC-এর সম্মিলিত সামরিক বাহিনী হিসেবে কাজ করে।
গত দুই দশকে GCC দেশগুলো একাধিকবার যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজন করেছে— যেমন ২০১৯ সালে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত “জয়েন্ট গালফ শিল্ড” মহড়া এবং ২০২২ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত আকাশ ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা মহড়া। এসব মহড়া সমন্বয় বাড়ালেও বাস্তব হামলার ক্ষেত্রে যৌথ প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছিল। কাতারে ইসরায়েলি আগ্রাসনই প্রথম বড় ঘটনা, যেখানে GCC দেশগুলো বাস্তবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরক্ষা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
ইসরায়েলি আগ্রাসনের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য
১. কাতারের কূটনৈতিক ভূমিকা দুর্বল করা
কাতার দীর্ঘদিন ধরে হামাস ও অন্যান্য পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মধ্যস্থতা করে আসছে। গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ে তার সক্রিয় ভূমিকা ইসরায়েলের জন্য অস্বস্তিকর। এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল হয়তো কাতারের কূটনৈতিক প্রভাব কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
২. GCC নিরাপত্তা কাঠামো বিভক্ত করার চেষ্টা
GCC দেশগুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে মতভেদ দেখা যায়। কাতারের ওপর হামলা হয়তো সেই বিভাজন বাড়িয়ে যৌথ প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা দুর্বল করার একটি কৌশল ছিল। তবে বাস্তবে GCC ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেছে।
৩. আঞ্চলিক মনোযোগ ভিন্নদিকে সরানো
ইসরায়েলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান। কাতারে হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল হয়তো উপসাগরীয় দেশগুলোর মনোযোগ গাজা বা ইরান থেকে সরিয়ে নিজের নিরাপত্তা এজেন্ডার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছে।
৪. মানসিক চাপ সৃষ্টি ও প্রতিরক্ষা চুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা
সীমিত আক্রমণ চালিয়ে ইসরায়েল হয়তো GCC প্রতিরক্ষা চুক্তির কার্যকারিতা যাচাই করতে চেয়েছে— সদস্য রাষ্ট্রগুলো কত দ্রুত ও ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে তা পরীক্ষা করার জন্য।
ইসরায়েলের কাতার আক্রমণ GCC দেশগুলোকে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এটি GCC-এর সমষ্টিগত প্রতিরক্ষা চুক্তিকে বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণ গড়ে তুলেছে। ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ছিল বিভাজন সৃষ্টি করা, কিন্তু এর ফলে GCC আরও সুসংহত ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।