Sliderবিশ্বসংবাদ বিশ্লেষণ

আলাল্ ‘আহ্দি ইয়া কুদস্

আলাল্ ‘আহ্দি ইয়া কুদস্
হে কুদস! আমরা আমাদের ওয়াদা ও আহদ (প্রতীজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি)-এর ওপর (অটল ও প্রতিষ্ঠিত) আছি । এটা ছিল এ বছরের আল-কুদস দিবসের বিশ্বব্যাপী প্রধান শ্লোগান ও শিরোনাম। বিশ্ব আল-কুদস দিবস মহান আল্লাহর দিবস, ইসলামের দিবস, বিশ্ব মানবতার দিবস, অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার-বৈষম্যবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মজলুম, নিপীড়িত-নির্যাতিত অত্যাচারিত ও অধিকারহতদের প্রতিবাদ দিবস।
ফিলিস্তিন ও আল-কুদস এ দুটি সম্মানিত স্থান সংগ্রামের প্রতীক। ফিলিস্তিন সমস্যার সুষ্ঠু ও ন্যায্য সমাধান মানবজাতির সকল সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি। কারণ এ সমস্যার ন্যায্য ও সুষ্ঠু সমাধান হচ্ছে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, কায়েমী স্বার্থবাদ ও বৈষম্যবাদের যবনিকাপাত ও পরিসমাপ্তি এবং মানবজাতির মহামুক্তির ( ফারাজ) বার্তাবাহক। বিশ্ব লুটেরা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণভোমরা হচ্ছে ইসরাইল।
মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র পশ্চিম এশিয়ার (মধ্যপ্রাচ্য) বিষফোঁড়া ইসরাইলকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ বিশেষ করে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রত্যক্ষ সমর্থন এবং সার্বিক মদদ, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে প্রতিষ্ঠিত করেছিল মুসলিম বিশ্বকে পদানত ও দাবিয়ে রাখার জন্য।
তেল ও খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা দখল ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এ অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু ফিলিস্তিনে এ ভূখণ্ডের প্রকৃত অধিবাসীদের ( আরব মুসলিম ফিলিস্তিনী জাতি) গণহত্যা চালিয়ে বলপূর্বক উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করে। ইসরাইলের মত জবরদখলকারী দখলদার সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। ১৯৪৮ সালে ‘ইসরাইল’ নামের পশ্চিমাদের এই সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয় ফিলিস্তিনে সন্ত্রাসবাদ, গণহত্যা, অপরাধ, আগ্রাসন ও লুটতরাজের মাধ্যমে।
ইসরাইল আসলে প্রকৃত কোনো দেশ বা রাষ্ট্র ও জাতি নয়। এটা হচ্ছে একটা সন্ত্রাসী সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধবাজ সামরিক জান্তা, গোষ্ঠী ও সংগঠন (আসলে যায়নবাদী সংগঠন)। যদি কেউ এটিকে দেশ বলতে চায় তবে তার বলা উচিত: ইসরাইল কৃত্রিম, মিথ্যা ও বাতিল দেশ, রাষ্ট্র ও জাতি। তাই দেশ , রাষ্ট্র ও জাতি হিসেবে ইসরাইল কখনোই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়। বরং এর বিলুপ্তি আশু প্রয়োজন ও একান্ত কাম্য। মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ায় গোলযোগ, অস্থিরতা, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘাত, সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব, বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধের মূলহোতা ও নারদ মণি হচ্ছে এই যায়নবাদী সন্ত্রাসী ইসরাইল। ইহুদী ধর্মের ধোঁয়া তুলে নাস্তিক্যবাদী সেক্যুলার যায়নিস্টরা ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করলেও ধর্মপ্রাণ ইহুদীরা এটিকে স্বীকৃতি দেয় না । তারা ইসরাইলকে ইহুদী ধর্ম ও তৌরাতের পরিপন্থী বলে গণ্য করে এবং তাঁরা এর বিলুপ্তি ও পতন কামনা করে।
অতএব ইসরাইল ইহুদী ধর্ম ও জাতির মোটেও প্রতিনিধিত্ব করে না বরং এটি হচ্ছে বিশ্ব লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি সমূহ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থাৎ শয়তানের সাক্ষাৎ প্রতিভু ও প্রতিনিধি। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা যায়নবাদীরা আসলে কোনো ধর্মমতে বিশ্বাসী নয়। এরা সেক্যুলারিজম, বস্তুবাদ, স্বার্থবাদ ও ভোগবাদে বিশ্বাসী। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ ইহুদীরা ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই এই মিথ্যা বাতিল মেকি কৃত্রিম দেশ ও রাষ্ট্রটির অস্তিত্বের বিরোধিতা করে আসছে এবং কখনো স্বীকৃতি দেয় নি। এই ধর্মপ্রাণ ইহুদীরা ইসরাইল সংক্রান্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নীতির সাথে একমত এবং তারা মজলুম ফিলিস্তিনীদেরও সমর্থক। তারাও বিশ্বাস করে ফিলিস্তীন ভুখন্ড ফিলিস্তিনী জাতির এবং তাদের কাছেই এ ভুখন্ড ফিরিয়ে দিতে হবে। স্মর্তব্য যে এই ধর্মপ্রাণ ইহুদীরাও মুসলমানদের সাথে দেশে দেশে এমনকি ব্রিটেন, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় রমযানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব আল-কুদস দিবস পালন এবং কুদস মুক্তির মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগদান করে এবং অনেক সময় তারা পুলিশের হয়রানি, ধরপাকড় ও গ্রেফতারির শিকার হয়ে থাকে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর ইমাম খোমেনী ঐ বছর রমযানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব আল-কুদস দিবস ঘোষণা করেন এবং ঐ বছর রমযানের শেষ শুক্রবার প্রথম আল-কুদস দিবস পালিত হয় সমগ্র ইরান জুড়ে। তখন থেকে ৪৬ বছর ধরে আল-কুদস পালিত হচ্ছে ইরান, গাজা, ইরাক, ইয়ামান, বাহরাইন, লেবানন, নাইজেরিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, জর্দান, অধিকৃত ফিলিস্তিন, ভারত, কাশ্মীর, দক্ষিণ আফ্রিকা, আফ্রিকান দেশসমূহ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া , ইউরোপ,উত্তর আমেরিকা ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) ও দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়।
রাজতান্ত্রিক আরব দেশগুলো ও মিসর কেবল এর ব্যতিক্রম। যদি এ সব দেশের সরকারগুলো বাধা না দেয় তাহলে ঐ সব আরবদেশের জনগণও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এ দিবস পালন করবে। অনেক সময় পূর্ব সৌদী আরবে জনগণ সৌদী সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আল-কুদস দিবসের মিছিল বের করে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নিগ্রহ ও ধরপাকড়ের শিকার হয়। ২৭ রমযান রাতে আল-কুদস দিবসের মিছিলে অংশ গ্রহণ করার জন্য ইরানী জাতির প্রতি আয়াতুল্লাহ খামেনেঈর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইরানীরা এ বছর ( ২৮-৩-২০২৫) পূর্ববর্তী বছরগুলোর চাইতে অধিক সংখ্যায় ও অধিক উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আগ্রহ সহকারে ইরানের ৯০০ এর অধিক শহর ও হাজার হাজার গ্রামে আল-কুদস দিবসের মিছিল, সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন যা ইসলাম, ফিলিস্তিন ও ইরানের শত্রুদেরকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে। যেমন বিবিসি ২০১৩ সালের ২ আগষ্ট ইরানে বিশ্ব আল-কুদস দিবস উদযাপনের প্রতিবেদন এভাবে উল্লেখ করেছিল:” প্রতি বছর ইরান আল-কুদস দিবস বা জেরুজালেম দিবস উদযাপন করে এবং মিছিল, সমাবেশ, উদযাপন ও ভাষণ শোনার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন জনতাকে রাস্তায় নামায়।”

ইহুদী পত্রিকা দ্যা জুইশ ক্রনিকল ২০১৮ সালের ৮ জুন ইরানে আল-কুদস দিবস উদযাপনের খবর এভাবে করেছিল: “যখন গোটা ইরান জুড়ে মিলিয়ন মিলিয়ন জনতা আল-কুদস দিবসের মিছিল, সমাবেশ ও র্্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য রাস্তায় নেমে আসে ঠিক তখন বড় ধরনের প্যারেড ও র্্যালি লেবানন, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ দেশে দেশে অনুষ্ঠিত ও উদযাপিত হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিবছর আল-কুদস দিবসে মিলিয়ন মিলিয়ন ইরানী এবং বিশ্বজুড়ে মিলিয়ন মিলিয়ন জনতা ফিলিস্তিনীদের প্রতি ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করার লক্ষ্যে মিছিল সমাবেশ ও র‌্যালিতে অংশগ্রহণ করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃত বাস্তবতা যা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম ও পত্রিকা সমূহ বলতে চায় না বরং চেপে রাখে ও গোপন করে রাখে। তবে কখনো কখনো ওদের মুখ ফসকে সত্য কথা বেরিয়ে পড়ে!! গতকাল ৪৭ তম বিশ্ব আল-কুদস দিবসে ইরানী জাতি পবিত্র আল-কুদস, মসজিদুল আকসা ও ফিলিস্তিনীদের প্রতি তাঁদের ওয়াদা ও অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আলাল আহদি ইয়া কুদস!( হে কুদস! আমরা আমাদের প্রতীজ্ঞা ও অঙ্গীকারের ওপর অটল ও বহাল আছি।) গোটা মুসলিম উম্মাহর উচিত আল-কুদস ও ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে সংগ্রাম করা। ধ্বংস হোক ইসরাইল।নিপাত যাক ইসরাইল। ইসরাইল বাতিল ও মিথ্যা। আর বাতিল ও মিথ্যা বিলুপ্ত ও ধ্বংস হবেই। কারণ বাতিল ও মিথ্যার কোনো স্থায়িত্ব নেই। তাই ইসরাইল অবশ্যই বিলুপ্ত হবে এবং সেটা অতিনিকটেই।

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক
মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button