বিশ্বকুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদসংবাদ বিশ্লেষণ

কেন কোরআনের তাফসীর নিজের মতো ব্যাখ্যা করা কুফরের সমতুল্য ?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামের দার্শনিক ও তফসীরী ধারায়, বিশেষ করে আহলে বাইতের শিক্ষা অনুযায়ী, কোরআন আল্লাহর প্রদত্ত দিশারী ও আলোর গ্রন্থ হিসেবে নাজিল হয়েছে। এটি আল্লাহর শব্দসমষ্টি, যার মূল উদ্দেশ্য মানবজাতিকে সরল ও সঠিক পথের দিকে পরিচালনা করা। তবে কোরআন নিজেই নির্দেশ দেয় যে, এর গভীর জ্ঞান, সম্পূর্ণ উপলব্ধি ও সঠিক ব্যাখ্যা করা সহজ কাজ নয়। এই স্তরের জ্ঞান ও আভ্যন্তরীণ রহস্য আবিষ্কার করার ক্ষমতা আল্লাহ রাসিখুন ফিলইলম (গভীর জ্ঞানসম্পন্ন) ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত রেখেছেন (আল ইমরান/৭):

﴿وَ مَا یَعْلَمُ تَأْوِیلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَ الرَّاسِخُونَ فِی الْعِلْمِ﴾

এটি ব্যাখ্যা করতে জানে কেবল আল্লাহ এবং গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা।

এই আয়াত স্পষ্ট করে যে কোরআন বোঝার স্তর রয়েছে—

১- বাহ্যিক স্তর: যা সাধারণ মানুষ শব্দ এবং আকার থেকে বোঝে।

২- অন্তর্নিহিত বা গোপন স্তর: যা শুধুমাত্র আল্লাহর জ্ঞান এবং বিশেষজ্ঞদের (রাসিখুন ফি-লইলম) মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়।

পাঠ্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা

কোরআনের প্রতিটি দিক বুঝতে এবং সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে, প্রয়োজন আছে প্রকাশিত শিক্ষকের সংস্পর্শে থাকা, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর উত্তরাধিকারী স্থলাভিষিক্ত (আহলে বাইত) সাথে সংযুক্ত থাকা। কারণ অনেক আয়াত متشابه (অনুরূপ বা বহু-অর্থপূর্ণ), এবং যদি কেউ এই আয়াতগুলোকে নিজস্ব ব্যাখ্যায় বোঝার চেষ্টা করে, তবে তা সহজেই ভুল ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। মানুষের বোঝাপড়া একেকজনের ক্ষেত্রে আলাদা হওয়ায় কোরআনের ব্যাখ্যায়ও বিভাজন দেখা দেয়।

সুতরাং স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা বা তাফসীর-বি-রায় করার প্রবণতা সরাসরি বিপদজনক। ইসলামিক ইতিহাসে সকল বিভক্তি মূলত এই ধরনের ব্যাখ্যার পার্থক্য থেকে উদ্ভূত। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং আহলে বাইত স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ব্যাখ্যা নেওয়া উচিত তাদের কাছে যাদের অধিকার দেওয়া হয়েছে।

আমীরুল মুমিনীন (আ.) বলেছেন: আল্লাহর কথা মানুষের কথার মতো নয়, যেমন আল্লাহর কাজও মানুষের কাজের মতো নয়। এই কারণেই কোরআনের প্রকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা কেবল রাসূল এবং তাঁর ওয়াসিয়াদের জন্য উন্মুক্ত।

তিনি আরও বলেছেন: যারা অনুরূপ আয়াতগুলোতে নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রয়োগ করেছে, তারা ধ্বংস হয়েছে, কারণ তারা সত্যিকার অর্থ বুঝেনি এবং বাস্তবতাকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তারা নিজের মত ব্যাখ্যা তৈরি করেছে এবং ওয়াসিয়াদের কাছে প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করেনি, এবং রাসূলের কথা উপেক্ষা করেছে।

ইমাম সাদিক (আ.) স্পষ্টভাবে বলেছেন:

وَ مَنْ فَسَّرَ آیَةً مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَر

যে কেউ আল্লাহর কোনো আয়াতকে নিজের মত ব্যাখ্যা করে, সে কুফর করেছে।

এটি ইসলামের তাফসীর শাস্ত্রে সর্বাধিক কঠোর সতর্কবার্তা, যা দেখায় যে কোরআনের প্রতি সম্মান এবং সঠিক ব্যাখ্যার জন্য রাসূলুল্লাহ ও আহলে বাইতের অব্যাহত শিক্ষার উপর নির্ভর করা অপরিহার্য।

 : আল্লাহর নির্দেশ গভীর জ্ঞানের অবজ্ঞা

প্রথম কারণ হলো, কোরআন ব্যাখ্যার গভীর স্তরগুলো শুধুমাত্র আল্লাহর অধীনে এবং রাসিখুন ফিলইলম (গভীর জ্ঞানসম্পন্ন) ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত।

১.রাসিখুন ফিলইলমের মর্যাদা দাবি করা:

আল ইমরান/৭ আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, গভীর স্তরের ব্যাখ্যা ও আভ্যন্তরীণ রহস্য বোঝা শুধুমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর গুণী প্রেরিতদের জন্য। কেউ যদি এই মর্যাদা ছাড়াই, নিজস্ব মেধা ও অনুমান দিয়ে ব্যাখ্যা করে, তাহলে তিনি প্রকৃতপক্ষে নিজেকে সেই মর্যাদায় স্থাপন করছেন যা আল্লাহ বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন। এটি ‘নবুয়াত দাবি’ বা ‘জ্ঞানলাভ দাবি’ করার সমতুল্য।

২.আল্লাহর আদেশকে মানবীয় রূপে রূপান্তর করা:

যখন কেউ সীমিত মানব জ্ঞান ও স্বার্থের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করে, তখন তা আল্লাহর আদেশকে মানবিক দৃষ্টিকোণে পরিণত করে। এটি ইসলামের বিধানকে নিজের ইচ্ছার অধীনে আনা বা কার্যত শিরক/কুফরের সমতুল্য।

 : আল্লাহর উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি সম্প্রদায়ের বিভ্রান্তি

দ্বিতীয় স্তর হলো, স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দ্বারা আল্লাহর মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটে এবং সমাজকে বিপদে ফেলে।

১.শরিয়াহর অর্থ বিকৃত করা:
ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা, নবী ও ইমামদের শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ধর্মীয় আইন (عملیه) বা বিশ্বাসমূলক নীতিকে বিকৃত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি নিজের ব্যাখ্যা দিয়ে ‘তাওহীদ’ বা ‘ন্যায়বিচার’ বোঝার চেষ্টা করে যা ইসলামিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবে তা ধর্মকে দুর্বল করে।

২.বিদআত এবং ইতিহাসের শিক্ষা:
ইসলামের ইতিহাসে বহু বিভাজন ও সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে, যার শুরু ছিল স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা এবং ব্যক্তিগত অনুমানের মাধ্যমে। এ ধরনের ব্যাখ্যা ধর্মের মূল পথ থেকে বিচ্যুতি এবং কুফরের দিকে নিয়ে যায়।

: আহলে বাইত এবং ইমামদের প্রতি অবজ্ঞা

তৃতীয় স্তর হলো, যে ব্যাখ্যাকারী স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা করে, সে আহলে বাইতের (ইমামদের) মর্যাদা অগ্রাহ্য করছে।

১. সাকলাইন ثقلینএর চুক্তি লঙ্ঘন:
আহলে বাইত বারবার সঠিক ব্যাখ্যা এবং স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা এই সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে নিজের মত ব্যাখ্যা করে, তারা ইমামের প্রতি অবজ্ঞা (جحد) প্রদর্শন করছে।

২.স্বাধীন ব্যাখ্যা বনাম আনুগত্য:
ইসলাম এক ধরনের ধারাবাহিক আনুগত্যের ধর্ম। ইমাম নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যার পথ দেখালে, তা মেনে চলাই আল্লাহর আনুগত্য। যে কেউ স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা করে, সে নিজেকে ধর্মীয় মর্যাদায় স্থাপন করছে যা কেবল নবী ও ওসিয়াদের জন্য সংরক্ষিত। এটি সরাসরি আহলে বাইতের মর্যাদা অগ্রাহ্য করা এবং মক্তেব-শিয়ায় অবিশ্বাসের সমতুল্য।

কুফরের স্তর এবং বিশ্লেষণ

১.এখানে যে কুফরের কথা বলা হয়েছে, তা সরাসরি আধ্যাত্মিক কুফর নয় (অর্থাৎ ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুতি নয়), বরং প্রায়শই কুফরী কাজ বা ব্যাখ্যায় অব্যাহতি।

২.যারা জানে আহলে বাইত হলো যথাযথ ব্যাখ্যার উৎস, যারা স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা নিষিদ্ধ তা জানে, তারপরও নিজের মত ব্যাখ্যা অব্যাহত রাখে—তাদের ক্ষেত্রে এটি কুফরী কাজের সমতুল্য।

উপসংহার

১. স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা কেবল একটি ভুল নয়; এটি ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

২. এটি আল্লাহর উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটায় এবং ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মৌলিক নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে।

৩. সমাধান: শুধুমাত্র আহলে বাইতের বিজ্ঞানের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য এবং নিয়মিত তাঁদের শিক্ষা থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণ। এটি নিশ্চিত করে যে আমাদের বোঝাপড়া আল্লাহর প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

সূত্র: আল্লামা জওয়াদী আ’মেলী, তাফসীরসমূহ:

১.কোরআনের গভীর অর্থ ও আভ্যন্তরীণ রহস্য কেবল আহলে বাইত ও রাসিখুন ফি-লইলম ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত।

২.ফিকহ ও হাদিস গ্রন্থ

ওয়াসাইলুস শিয়া, খণ্ড ২৭, পৃষ্ঠা ২১: স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা এবং তাফসীর-বি-রায়ের বিপদ, আহলে বাইতের মর্যাদা ও নির্দেশ।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button