জায়োনবাদীদের চোখের কাঁটা: ইতিহাস বদলে দেওয়া এক বীরের কাহিনি
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
জায়োনবাদীদের চোখের কাঁটা “সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ”: ইতিহাস বদলে দেওয়া এক বীরের কাহিনি
মিডিয়া মিহির: লেবানন তথা পুরো মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে খ্যাত শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহকে স্মরণ করছে পুরো মুসলিম বিশ্ব। দক্ষিণ লেবানন মুক্ত করা থেকে শুরু করে ৩৩ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলকে পরাজিত করা পর্যন্ত, তাঁর নেতৃত্ব হিজবুল্লাহকে আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তর করেছে।
আজ তাঁর শাহাদাতের প্রথম বার্ষিকীতে তাঁকে শুধু লেবাননের নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর প্রতিরোধের স্থায়ী প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রতিরোধের স্থপতি
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ছিলেন হিজবুল্লাহর তৃতীয় মহাসচিব ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯২ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ২০২৪ সালে শাহাদাত লাভ করা পর্যন্ত তিনি হিজবুল্লাহকে স্থানীয় সংগঠন থেকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী শক্তিতে রূপান্তর করেন। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ লেবানন মুক্ত হয় (২০০০), বন্দিদের মুক্ত করা হয় এবং শহীদদের মরদেহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। এছাড়া ২০০৬ সালের ৩৩ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিজয় হিজবুল্লাহর ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে।
শৈশব ও শিক্ষা
হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৬০ বা ১৯৬২ সালের ৩১ আগস্ট বৈরুতের পূর্বাঞ্চলের এক এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমে লেবাননে, পরে ইরাকের নাজাফে পড়াশোনা করেন। ইরাকের সাদ্দাম হোসাইনের বাথ পার্টির নির্যাতনের কারণে তিনি লেবাননে ফিরে আসেন এবং পরে ইরানে যান। কোমে অবস্থানকালে তিনি ইমাম খোমেনী’র (রহ.) বিপ্লবী চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হন এবং ফার্সি ভাষা শেখেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ইমাম খোমেনীর (রহ.) প্রতিনিধি হিসেবে লেবাননে দায়িত্ব পালন করেন।
নেতৃত্বের পথে
১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি শিয়া রাজনৈতিক সংগঠন ‘আমল মুভমেন্ট’-এ সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে ইসরাইলের লেবানন আক্রমণের পর তিনি একদল সংগ্রামী আলেমকে নিয়ে হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেন। লেবাননের শিয়াদের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল ইমাম মূসা সাদরের হাত ধরে, আর হাসান নাসরুল্লাহ ও তাঁর সহযোদ্ধারা তা পূর্ণতা দেন।
১৯৯২ সালে সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভীর শাহাদাতের পর নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর মহাসচিব নির্বাচিত হন এবং ২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইহুদিবাদী দখলদার বাহিনীর বোমা হামকায় শাহাদাত পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
দক্ষিণ লেবাননের মুক্তি ও ২০০৬ সালের যুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য হাসান নাসরুল্লাহ শুধু লেবানন নয়, সমগ্র আরব বিশ্বের সাহসী ও জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত হন। পশ্চিমা বিশ্লেষক এবং এমনকি ইসরাইলি কৌশলবিদরাও তাঁকে “সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী আরব নেতা” হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
প্রতিরোধের অক্ষ ও কৌশলগত সম্পর্ক
হাসান নাসরুল্লাহ সর্বদা নিজেকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সৈনিক বলে পরিচয় দিতেন। ২০০৯ সালে তিনি হিজবুল্লাহর নতুন রাজনৈতিক নীতি প্রকাশ করেন যেখানে ইরানের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যকে দলীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি শহীদ কাসেম সোলাইমানি ও শহীদ হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে সহায়তা থেকে শুরু করে সিরিয়ায় আইএস ও তাকফিরি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই—সব ফ্রন্টে নাসরুল্লাহর নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত কার্যকর। তাঁর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ লেবাননের সীমা ছাড়িয়ে সমগ্র অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রধান খেলোয়াড়ে পরিণত হয়।
শাহাদাত ও উত্তরাধিকার
২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর যখন হিজবুল্লাহ গাজায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে সহায়তা করছিল, ইসরাইলি বিমান বাহিনী বৈরুতের দাহিয়্যাহ এলাকায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালায়। এতে হাসান নাসরুল্লাহ শাহাদাত লাভ করেন। ইসরাইলি গণমাধ্যম স্বীকার করে যে তাঁকে হত্যার জন্য ৮০ টনেরও বেশি বাংকার-বাস্টার বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল।
লেবাননে বোমাবর্ষণ ও হাসান নাসরুল্লাহর শাহাদাতেও লেবাননের সরকার ও সেনাবাহিনী আগের মতোই নীরব থাকে। তবে নাসরুল্লাহর জানাজা শত সহস্র মানুষের উপস্থিতিতে এবং ৭৯টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে এক ঐতিহাসিক ঘটনায় পরিণত হয়।
শ্রদ্ধাঞ্জলি ও বার্তা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাঁর শাহাদাতের পর আবেগঘন বার্তায় নাসরুল্লাহকে “মহান মুজাহিদ ও প্রতিরোধের অগ্রগামী নেতা” আখ্যা দিয়ে বলেন, “তাঁর পবিত্র দেহ ভূমিতে শায়িত হলেও তাঁর আত্মা ও আদর্শিক পথ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং প্রতিদিন প্রতিরোধের পথিকদের অনুপ্রাণিত করবে। শত্রু জানুক, প্রতিরোধের পথ থেমে নেই, এটি শেষ হবে না যতক্ষণ না আমরা চূড়ান্ত বিজয়ে পৌঁছাই।”
প্রতিরোধের নতুন অধ্যায়
আজ তাঁর শাহাদাতের বার্ষিকীতে— হাসান নাসরুল্লাহ কেবল লেবাননের নয়, বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর প্রতিরোধের প্রতীক। তিনি ছিলেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কণ্ঠস্বর, মর্যাদার পতাকাবাহী এবং এমন এক নেতা যিনি নিজের রক্ত দিয়ে আঞ্চলিক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছেন। তাঁর শাহাদাত কোনো সমাপ্তি নয়—বরং প্রতিরোধের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।



