ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের উপায়
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৯ অক্টোবর
মিডিয়া মিহির: ধর্মীয় বাণী ও ইমামগণের (আ.) হাদীসের আলোকে দেখা যায়, একজন উপযুক্ত জীবনসঙ্গী নির্বাচনের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন— ঈমান, উত্তম চরিত্র, সৎ পরিবার, বুদ্ধিমত্তা, মানসিক ও সামাজিক সামঞ্জস্য (কাফু), জ্ঞান, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, সৌন্দর্য, পবিত্রতা এবং যৌন চাহিদার প্রতি সঠিক দৃষ্টি। একটি সঠিক বিবাহ কেবল দুটি হৃদয়ের মিলন নয়, বরং দুটি আত্মার পবিত্র বন্ধন। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ডের আলোকে যদি জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা যায়, তবে তা শুধু পারিবারিক সুখই নয়— বরং এক পূর্ণাঙ্গ, শান্তিময় জীবনের দ্বার উন্মোচন করে। ইসলামের নির্দেশনায়, উপযুক্ত জীবনসঙ্গী সেই ব্যক্তি, যার হৃদয়ে ঈমান, আচরণে নীতি, এবং চরিত্রে আল্লাহভীতি প্রতিফলিত হয়।
বিবাহ: জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্ত
জীবনসঙ্গী নির্বাচন এমন একটি সিদ্ধান্ত যা একজন মানুষের পুরো জীবনকে প্রভাবিত করে। ইসলামী শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধের আলোকে বিবাহ করলে তা মানসিক শান্তি, পারিবারিক সুখ ও জীবনের পূর্ণতা বয়ে আনে। একজন সৎ ও উত্তম জীবনসঙ্গী মহান আল্লাহর অন্যতম বড় নিয়ামত। এমন সঙ্গী পরিবারে সৌভাগ্য, উন্নতি, অন্তরের প্রশান্তি, সুশিক্ষিত সন্তান এবং বিশুদ্ধ বংশধারা গঠনের কারণ হয়। তাই বিয়ের সময় বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে যেন তিনি আমাদের জন্য একজন নেক জীবনসঙ্গী নির্ধারণ করেন।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন:
“তোমাদের কেউ যখন বিয়ের ইচ্ছা করে, তখন যেন দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, যেন তিনি এমন এক জীবনসঙ্গী দান করেন যে হবে ধর্মপরায়ণ, বিশ্বস্ত, মার্জিত, লজ্জাশীলা ও গোপনীয়তার রক্ষক।”
তিনি আরও উপদেশ দেন, বিয়ের সময় আবেগ, আকর্ষণ বা কল্পনার বশবর্তী না হয়ে, পিতা-মাতা ও অভিজ্ঞ পরামর্শকের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
ভালো জীবনসঙ্গীর সাধারণ গুণাবলি (পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য)
১. ঈমান ও ধর্মপরায়ণতা
ইমাম বাকের (আ.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বিয়ের বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। নবীজী বললেন, এমন ব্যক্তিকে বিয়ে করো যে আল্লাহভীরু ও ধর্মপরায়ণ।
২. সদাচরণ ও উত্তম চরিত্র
ইমাম রেজা (আ.)-কে এক ব্যক্তি লিখলেন, “আমার আত্মীয়দের একজন খারাপ স্বভাবের লোক আমার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, কী করা উচিত?”
ইমাম উত্তরে বললেন, “যদি সে খারাপ স্বভাবের হয়, তাহলে তোমার মেয়েকে তাকে দিও না।”
৩. সৎ ও সম্মানিত পরিবার
পারিবারিক সম্মান কেবল ধনসম্পদ বা সামাজিক মর্যাদায় নয়; বরং ধার্মিকতা, শালীনতা ও চরিত্রেই নিহিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন:
“উত্তম পরিবারে বিয়ে করো, কারণ বংশ ও বীজ (রক্তের প্রভাব) প্রজন্মে প্রভাব ফেলে।”
৪. বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা
ইমাম আলী (আ.) বলেন: “মূর্খ ও অজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে করো না; তার সঙ্গে বসবাস বড় বিপদ এবং তার সন্তানরাও অপচয় হবে।”
৫. সমমান ও সামঞ্জস্য (কাফু)
ধর্ম, নীতি, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা, মানসিকতা, বয়স, শারীরিক ও মানসিক সাদৃশ্যের দিক থেকে যতটা সম্ভব সামঞ্জস্য থাকা দরকার।
৬. জ্ঞান ও শিক্ষিত মন
জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া সহজ হয়, জীবনের আনন্দও গভীর হয়।
৭. শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা
অসাধ্য শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা বিয়ে-পরবর্তী জীবনে বড় বাধা হতে পারে। ইসলাম কুষ্ঠ, পাগলামি, গুরুতর ত্বকের রোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে।
৮. সৌন্দর্য
নবী করিম (সা.) বলেন:
“যেমনভাবে তোমরা মুখের সৌন্দর্য খোঁজ করো, তেমনি চুল ও সামগ্রিক সৌন্দর্য সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করো।”
৯. লজ্জাশীলতা ও পবিত্রতা
বিবাহ পারস্পরিক একচেটিয়া সম্পর্ক— যেখানে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতা ভিত্তি।
১০. যৌন চাহিদার সঠিক পূরণ
শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা এবং পারস্পরিক সন্তুষ্টি রক্ষা করা বৈবাহিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
উত্তম স্ত্রীর গুণাবলি
১. স্বামী আল্লাহকে স্মরণ করলে সহায়তা করা, ভুলে গেলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
২. ধর্ম ও নৈতিকতায় স্বামীকে সহযোগিতা করা।
৩. কম ব্যয়বহুল ও সহজ স্বভাবের হওয়া।
৪. স্নেহময়, মিষ্টভাষী ও সহৃদয় হওয়া।
৫. সন্তান ধারণে সক্ষম হওয়া।
৬. ঘরকে শান্তির আশ্রয় বানানো।
৭. স্বামীর পরিশ্রমের কদর করা।
৮. স্বামীকে তার সাধ্যের বাইরে কিছু না চাওয়া।
৯. স্বামীর অনুপস্থিতিতে ঘর ও নিজের সম্মান রক্ষা করা।
১০. স্বামীর জন্য সাজগোজ করা ও মনোরম থাকা।
১১. বাইরে গেলে পর্দাশীল ও গম্ভীর থাকা।
১২. অন্য পুরুষদের প্রশংসা না করা।
১৩. ভুল হলে ক্ষমা চাওয়া।
১৪. স্বামীকে খুশি রাখা ও রাগ প্রশমিত করা।
১৫. স্বামীর বৈধ আদেশ মানা।
১৬. পরিমিত ব্যয় করা।
১৭. স্বামী ভুল করলে ক্ষমা করা।
১৮. ঘর পরিচ্ছন্ন, সুশৃঙ্খল ও আরামদায়ক রাখা।
১৯. সন্তানদের স্বাস্থ্য ও লালন-পালনে যত্নশীল হওয়া।
২০. বিশ্বস্ত, গোপনীয়তা রক্ষাকারী ও সত্যবাদী হওয়া।
উত্তম স্বামীর গুণাবলি
১. ধর্মপরায়ণতা।
২. সদাচরণ ও সহানুভূতি।
৩. বিচক্ষণতা, পরিশ্রম ও দায়িত্ববোধ।
৪. পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখের জন্য পরিশ্রমী হওয়া।
৫. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল হওয়া।
৬. মিতব্যয়ী ও সংযমী হওয়া।
৭. স্ত্রীর প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
৮. স্ত্রীকে ভালোবাসা ও ভালোবাসা প্রকাশ করা।
৯. স্ত্রীর ভুলত্রুটি ক্ষমা করা।
১০. পরনারীর প্রতি দৃষ্টি না দেওয়া।
১১. গৃহকর্মে সহযোগিতা করা।
১২. ক্রোধ সংবরণ করা ও স্ত্রীর প্রতি কখনো অশোভন আচরণ না করা।
উপসংহার
বিবাহ শুধু সামাজিক সম্পর্ক নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক চুক্তি— আল্লাহর নামে, ভালোবাসা, দায়িত্ব ও সম্মানের ভিত্তিতে। একজন ধর্মপরায়ণ, নীতিবান ও বুদ্ধিমান সঙ্গী জীবনের শান্তি ও সফলতার চাবিকাঠি। তাই সঠিক জীবনসঙ্গী নির্বাচন মানেই সুন্দর জীবনের ভিত্তি স্থাপন।
তথ্যসূত্র
১. মুহাম্মদ হুসাইন নাজফি, জাওয়াহিরুল কালাম, খণ্ড ২৯, পৃষ্ঠা ৩৯, প্রকাশনা: দারুল ইহইয়াউত তুরাস আল-আরাবি, বৈরুত; সপ্তম সংস্করণ।
২.শেখ কুলাইনি, ফুরু’ আল-কাফি, সম্পাদনা: আলি আকবর গাফারি, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৩২, প্রকাশনা: ইসলামিয়্যাহ, তেহরান; ১৩৯১ হিজরি কোম।
৩.শেখ হুর আমেলি, ওয়াসায়েলুশ শিয়া, সম্পাদনা: রাব্বানি শিরাজি, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৫৪, প্রকাশনা: ইসলামিয়্যাহ, তেহরান; মহররম ১৩৮৪ হিজরি কোম।
৪.আলি আকবর মাযাহেরি, যুবক ও জীবনসঙ্গী নির্বাচন, পৃষ্ঠা ১১৫, প্রকাশনা: দাফতারে তাবলিগাতে ইসলামি, হাউজায়ে ইলমিয়া কুম; তৃতীয় সংস্করণ।
৫.শেখ হুর আমেলি, ওয়াসায়েলুশ শিয়া, সম্পাদনা: রাব্বানি শিরাজি, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৫৬, প্রকাশনা: ইসলামিয়্যাহ, তেহরান; মহররম ১৩৮৪ হিজরি কোম।
৬.আল্লামা মুহাম্মদ বাকের মাজলিসি, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১০৩, পৃষ্ঠা ২৩৭, প্রকাশনা: ইসলামিয়্যাহ, তেহরান।
৭.আয়াতুল্লাহ আমিনী, স্বামী-স্ত্রীর আচরণবিধি (আইনে হামসারদারি), ইসলামি প্রকাশন।
১০.আয়াতুল্লাহ আমিনী, স্বামী-স্ত্রীর আচরণবিধি (আইনে হামসারদারি), ইসলামি প্রকাশন।



