আজ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ৪৬তম বিজয় বার্ষিকী
আজ ১০ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ২২বাহমান ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ৪৬ তম বার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ইরানে পাশ্চাত্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পন্থী পাহলভী শাহান শাহী সরকারের চূড়ান্ত পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামী বিপ্লব সফল ও বিজয়ী হয় এবং ইরানে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই ইসলামী বিপ্লব ও শাসনব্যবস্থা শুরু থেকেই অন্যায়,শোষণ,সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরোধিতা ও এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে বিধায় সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদম শুরু থেকেই ইসলামী বিপ্লবী ইরান ও ইসলামী শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করে আসছে। যেমন: বিপ্লব বিজয়ের সাথে সাথেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা জারি করে যা ৪৬ বছর গত হয়ে গেলেও আজও অব্যাহত আছে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লব ও প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাযুরা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) মারাত্মক ষড়যন্ত্র করে যেতে থাকলে ইমাম খোমেইনীর মতাদর্শের অনুসারী একদল ছাত্র জনতা তেহরানে কার্যতঃ গুপ্তচরদের আড্ডা খানা বলে খ্যাত মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেয় এবং দীর্ঘ এক বছরের অধিক কাল ধরে মার্কিন দূতাবাস কর্মীরা বন্দী থাকে যারা ছিল কূটনীতিকদের ছদ্মবেশে আসলে মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও গুপ্তচর।

মার্কিন সরকার সেই সময় থেকে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে এবং প্রতি বছর তা নবায়ন করছে।
উল্লেখ্য যে তখন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাম্রাজ্যবাদী সংগ্রামের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ও প্রমাণ হচ্ছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামী বৈপ্লবিক নীতি অবস্থান এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামরত ফিলিস্তীনী মুক্তি কামী জনগণ, গ্রুপ ও দল সমূহকে সর্বাত্মক সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা। শুধু এখানেই থেমে থাকে নি ইসলামী বিপ্লবী ইরান বরং অত্র অঞ্চলে (পশ্চিম এশিয়া যা মধ্যপ্রাচ্য নামে অভিহিত) সাম্রাজ্যবাদ ও ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ইয়ামানে পশ্চিমা ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন ও দল সমূহের প্রতি রয়েছে ইরানের অকুণ্ঠ সমর্থন। একদম শুরু থেকেই ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের মুস্তাযাফ (নিপীড়িত নির্যাতিত অত্যাচারিত) ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত জনতা ও জাতিসমূহের পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং বর্তমানেও তা অব্যাহত আছে।

গাজায় ইসরাইলের সর্বাত্মক বর্বর আগ্রাসন,গণহত্যা-প্রজন্ম হত্যা এবং যাবতীয় মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনকে সর্বাত্মক সমর্থন, সহযোগিতা, সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে ইরান। ইরানের পূর্ণ সমর্থনে লেবাননের হিজবুল্লাহ আন্দোলন, ইরাকের প্রতিরোধ সংগ্রামী গ্রুপ সমূহ এবং ইয়ামানের আনসারুল্লাহ গাযায় ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসন,যুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ,গণহত্যা – প্রজন্ম হত্যার বিরুদ্ধে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং ইরানও ইসরাইলে দুবার সফল ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল।
আর এ প্রতিরোধ সংগ্রামে সিরিয়া ও লেবাননে বেশ কয়েকজন ইরানী জেনারেল এবং উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা গাজাবাসী ও লেবাননী শহীদানের পাশাপাশি ইসরাঈলের বিমান হামলায় শাহাদত বরণ করেছেন। অথচ তুরস্কের মতো বেশ কিছু মুসলিম দেশ সরাসরি প্রতিরোধ সংগ্রাম করা তো দূরের কথা বরং গোপন ও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এমনকি সামরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রেখেছে যা সত্যি লজ্জাকর ও দু:খজনক বিশেষ করে যখন গত এক বছরের অধিক কাল ধরে গাযা ও লেবাননে ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসন,যুদ্ধ ,গণহত্যা ও ধ্বংস চালাচ্ছিল ঠিক তখন! আর মার্কিন হামলায় বাগদাদ এয়ারপোর্টের অদূরে ২০২০ সালের ৩রা জানুয়ারি জেনারেল কাসেম সুলাইমানী ও ইরাকের হাশদুশ শা’বী গণবাহিনী প্রধান আবূ মাহদী আল-মুহান্দিসের শাহাদত প্রমাণ করে ইসলামী বিপ্লবী ইরানের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের বিষয়।

স্বয়ং ৪৫ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত কঠোর অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা থেকেও স্পষ্ট প্রমাণিত হয় ইসলামী বিপ্লবী ইরানের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রকৃতি, চেহারা ও চরিত্র। এ ছাড়াও ভেনেজুয়েলার মতো লাতিন আমেরিকান বেশ কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশের সাথেও জোরদার ও শক্তিশালী উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইরান যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চক্ষুশূল হয়ে আছে। আর এ থেকে প্রমাণিত হয় বিশ্ব পরিসরে বিশ্বের মযলূম নির্যাতিত জাতিসমূহের পক্ষে ইসলামী বিপ্লবী ইরানের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নীতি অবস্থান। আর এ নীতি অবস্থান আজও অপরিবর্তিত আছে। আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এ নীতি অবস্থানের কারণেই উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া ও চীনের সাথেও ইরানের রয়েছে শক্তিশালী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বস্তুতঃ ইরানের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক নীতি ও পলিসি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। আর নি:সন্দেহে এ কারণেই আজ বিশ্বে ইসলামী বিপ্লবী ইরান সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশগুলোর জন্য আলোকবর্তিকা বাহী অগ্রগামী দেশ ও বরণীয় আদর্শ। মুসলিম উম্মাহর এক নং সমস্যা হচ্ছে ফিলিস্তিন জবরদখলকারী হানাদার যায়নবাদী ইসরাইলী সরকার। আর ইসলামী বিপ্লবের ঊষালগ্নে তা স্পষ্ট চিহ্নিত করে সমাধান কল্পে যথাযথ বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন ইরানে ইসলামী বিপ্লব ও প্রজাতন্ত্রের স্থপতি ও প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী ( র,হ)।

আর বর্তমান মহামান্য রাহবার (নেতা) আয়াতুল্লাহ আল-উযমা ইমাম খামেনেয়ী তা অব্যাহত রেখেছেন। আসলে এই ফিলিস্তিন সমস্যার প্রকৃত ন্যায্য সমাধানে নিহিত রয়েছে মুসলিম উম্মাহর বাদবাকী সমস্যা সমূহের ন্যায্য ও স্বার্থক সমাধান। তাই ফিলিস্তীন সমস্যাকে সবচেয়ে বেশি ও সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যা হয়তো বহু মুসলিম দেশের সরকার গুলো বিবেচনা করে না ও ভাবে না। আর এ বিষয়টি গত ১৫ মাসের গাযা – ইসরাইল যুদ্ধ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে গেছে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর কাছে এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ও গুরুত্ব পেতে হবে। এ জন্যই ইসলামী বিপ্লবী ইরানের বৈপ্লবিক আদর্শ ও চিন্তাধারার সাথে মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্বকে সম্যকভাবে পরিচিত হতে ও তা ভালো ভাবে বুঝতে হবে।

ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ৪৬৩ম বার্ষিকীতে সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এ বিপ্লব নিছক ইরানী জাতির নয়। এ বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদ, অন্যায়,শোষণ, বৈষম্য ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সফল ইসলামী বিপ্লব যা সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ ও মঙ্গল আনয়ন করতে ও মুক্তির পথ দেখাতে সক্ষম। এ বিপ্লবের সুদূর প্রসারী প্রভাব রয়েছে যা সামনে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমরা ইরান ও বিশ্ব পরিসরে এ বিপ্লবের সুফল ও প্রভাব নিয়ে সামনে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব ।
ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক, মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫