Sliderধর্ম ও বিশ্বাস

ইসলামে রোজা কখন ফরজ হয়?

ইসলামে রোজা কখন ফরজ হয়?

রোজার সাধারণ অর্থ নিজেকে কিছু নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত রাখা, যা অতীত ধর্মগুলোতে যেমন ছিল ঠিক তেমনি জাহেলি যুগেও বিদ্যমান ছিল। ইসলামে ঠিক কীভাবে ও কখন রোজার প্রচলন শুরু হয় এবং কখন তা সকল প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানদের উপর ফরজ হয়- সে বিষয়ে অনেকের মনে কৌতুহল ও প্রশ্ন থাকতে পারে।
মেহের নিউজ এজেন্সির এক প্রতিবেদনে বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক মোহাম্মদ আমিন ঘরভি একটি বিশেষ নিবন্ধে ইসলাম এবং কুরআনে রোজার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা নিম্নে তুলে ধরা হলো:-
কুরআনে রোজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইসলামের শিক্ষাসমূহ অত্যন্ত বিস্তৃত এবং এগুলো বোঝার জন্য স্বচ্ছ চিন্তাধারা এবং বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি প্রয়োজন। অনেক লোক যদিও মুসলিম হননি, তবুও তারা ইসলামের নিয়ম ও শিক্ষার সঠিক ধারণা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। অন্যদিকে, প্রথম থেকেই অবিশ্বাসী ও ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামকে বিতর্কিত ও বিলুপ্ত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তারা কুরআন ও সুন্নাহর ভুল ব্যাখ্যা করেছে এবং ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। তবে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী- সমস্ত শয়তানী ষড়যন্ত্র একদিন ধ্বংস হয়ে ইসলাম তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবে। ইসলামে আইন প্রণয়নের পদ্ধতি মানবজাতির ইতিহাস এবং কুরআনের আয়াতের ভিত্তিতে দেখা যায়, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া সাধারণত এইভাবে শুরু হয় যে— প্রথমে মৌলিক নিয়ম বা “সংবিধান” তৈরি করা হয় পরে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় শর্তাবলী সংযোজন করা হয়- যা “উপধারা” নামে পরিচিত। এই কথা ইসলামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যে, মানবজাতির জন্য সর্বশেষ ও সর্বোৎকৃষ্ট কল্যাণকর ব্যবস্থা। মক্কায় ইসলামের আবির্ভাবের পর মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সমস্ত শরিয়তের আইন ও বিধানসমূহ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম)-এর হৃদয়ে নাযিল করেন। তবে, এই বিধানগুলো একবারে ঘোষণা করা হয়নি বরং ধাপে ধাপে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। কারণ নও মুসলিমরা সদ্য জাহেলি যুগীয় অমূলক বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত হয়েছিল মাত্র। হঠাৎ নতুন জীবনব্যবস্থার মুখোমুখি হলে তারা হয়তো ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে যেত। আর তাই ইসলামের বিধানগুলো ধীরে ধীরে প্রবর্তিত হয়ে নও মুসলিমদের জীবন মানের সাথে খাপ খাইয়েছে।
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার ইতিহাস হিজরতের দ্বিতীয় বছরে যখন পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩-১৮৫ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হয়, তখন মদিনায় রমজানের রোজা ফরজ হয়। তবে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগেও কিছু নির্দিষ্ট দিনে মুসলমানরা রোজা রাখত। নবী করিম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং তাঁর সাহাবিগণ প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে (যাকে “আইয়ামুল বাইদ” বলা হয়) রোজা রাখতেন। কিছু ঐতিহাসিক সূত্র মতে, হিজরতের আগেই মক্কায় কিছু নির্দিষ্ট দিনে (ওয়াজিব) রোজার বিধান প্রচলিত ছিল। কুরআনে রোজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রোজার সাধারণ অর্থ নিজেকে কিছু নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত রাখা, যা অতীত ধর্মগুলোতে যেমন ছিল ঠিক তেমনি জাহেলি যুগেও বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরআনে কমপক্ষে দু’টি স্থানে এই বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে। একবার সাধারণভাবে পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ.
তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। আবার অন্যস্থানে বনি ইসরায়েলের মধ্যে এই ইবাদতের প্রচলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে
: فَإِمَّا تَرَیِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَداً فَقُولی‏ إِنِّی نَذَرْتُ لِلرَّحْمنِ صَوْماً.
(হে মরিয়ম,) যদি তুমি কোনো মানুষকে দেখো যে তোমার পুত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে বলো যে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাওম বা রোজা মানত করেছি। অবশ্য ইসলামী শরীয়তে চুপ থাকার/নীরবতার রোজা (সওমে সমত) রহিত হয়ে গেছে।
কুরআনে রোজা সম্পর্কে স্পষ্টতা ইসলামের বিধান প্রণয়নে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার নীতির আলোকে সূরা বাকারার আয়াত ১৮৩-১৮৫-এর অর্থ স্পষ্ট হয়:-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ * أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ * شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ.
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (রোজা হলো) কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনের। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ বা সফরে থাকবে, সে অন্য দিনে রোজা পূরণ করবে। আর যারা রোজা রাখতে অক্ষম, তাদের জন্য একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করা আবশ্যক। তবে যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বেশি ভালো কাজ করে, তা তার জন্য উত্তম। আর রোজা রাখা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। রমজান মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাস পাবে, সে যেন রোজা রাখে। আর যে অসুস্থ বা সফরে থাকবে, সে অন্য দিনে রোজা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান কিন্তু তিনি কঠিনতা চান না। যাতে তোমরা গণনা পূরণ করতে পার এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে তোমাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করতে পার যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশক হও।” মুফাসসিরদের মতে, এই তিনটি আয়াত একসঙ্গে নাযিল হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
যেমন, আয়াত ১৮৫-এ «شَهْرُ رَمَضَانَ» (রমজান মাস) শব্দটি আয়াত ১৮৩-এ উল্লিখিত «أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ» (কয়েকটি নির্দিষ্ট দিন) শব্দটির ব্যাখ্যা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও, আয়াত ১৮৩ ও ১৮৪ আয়াত ১৮৫-এর জন্য প্রস্তুতিমূলক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কারণ, মুসলিমদের উপর একটি বিশেষ আমল ফরজ করা হচ্ছিল এবং প্রবক্তা (পয়গম্বর) নিশ্চিত ছিলেন না যে শ্রোতারা এর কঠোরতার কারণে তা পালন করতে অস্বীকার করবে কিনা। তাই ধাপে ধাপে এবং শ্রোতাদের মনে উদ্বেগ দূর করার জন্য রোজার কিছু বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। শেষে এ বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়েছে যে, এই বিধান প্রণয়নে সহজতা ও ছাড়ের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে।
সংযুক্তি: কুরআনের আলোকে রোজার বিধান সুরা বাকারা ১৮৩-১৮৫ আয়াতে রোজার বিধান বর্ণিত হয়েছে:
১. রোজা পূর্ববর্তী ধর্ম বিশ্বাসীদের উপরও ফরজ ছিল।
২. অসুস্থ বা মুসাফির হলে পরবর্তী সময়ে রোজা পূরণ করতে হবে।
৩. যারা রোজা রাখতে অক্ষম, তারা প্রতিদিনের জন্য একজন দরিদ্রকে খাওয়ানোর সমপরিমাণ ফিদিয়া দিবে।
৪. রমজান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে, তাই এ মাসের রোজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
এই আয়াতগুলো ধাপে ধাপে এসেছে যেন মুসলমানরা সহজে এই বিধান গ্রহণ করতে পারে এবং এতে যেন তাদের জন্য কোনো কঠোরতা না হয়। বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষের জন্য সহজ ব্যবস্থা করতে চান, কষ্ট দিতে চান না। উপলব্ধি ইসলামের বিধানগুলোর গভীর বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের অভাবের কারণে অনেক ইসলাম বিরোধী পক্ষ রোজার বিধান নিয়ে ভুল ধারণা পোষণের অপচেষ্টা করেছেন।
ইসলামী আইন ও শিক্ষা অধ্যয়নের সময় গভীর মনোযোগ ও সূক্ষ্মদৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামের শত্রুরা এই যোগ্যতা অর্জন থেকে বঞ্চিত, তাই তারা ইসলামে রোজা ফরজ হওয়ার বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি। তারা ভুলভাবে ধারণা করেছে যে ইসলাম এই গুরুত্বপূর্ণ ফরজ নির্ধারণে কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা রাখে না। অথচ পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ রোজার বিধান সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে।
তথ্যসূত্র ঃ [১]. আল-আনআম: ১৫১-১৫২; আল-বাকারা-১৮৩। [২]. ইমাম খোমেনী, তাহযীব আল-উসূল, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা- ২১২; তেহরানী, মাহজাত আল-উলামা, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ১০১; মাকারেম, আনওয়ারুল-উসূল, খণ্ড- ৩, পৃষ্ঠা- ৪৫৮। [৩]. মিলানী, তাহকীক আল-উসূল, খণ্ড- ৪, পৃষ্ঠা- ৪২৯। [৪]. তারিখ আল-তাবারী, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা- ৪১৭; মাজলিসী, বিহারুল-আনওয়ার, খণ্ড- ১৯, পৃষ্ঠা- ১৯৪। [৫]. তাফসীরে আল-কুম্মী, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ৬৫। [৬]. হালাবী, আল-সীরাহ আল-হালাবীয়াহ, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা- ১৮৭। [৭]. সুবহানী, সীরাতে জাওদানেহ, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ৫৭৪। [৮]. আল-বাকারা: ১৮৩। [৯]. মারইয়াম: ২৬। [১০]. তাবাতাবাঈ, আল-মীযান, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা: ৪-৫।
মিডিয়া মিহির/ধর্ম ও বিশ্বাস/রাসেল আহমেদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button