কুরআনকুরআন শিক্ষাজীবনযাপনতাফসীরধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

কীভাবে ধৈর্য্য ধারণের মাধ্যমে পরিপূর্ণতায় পৌঁছানো যায়?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির : ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগার ৫৫তম হিকমতে ধৈর্য্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন: এক, অপ্রিয় কর্মকাণ্ডে ধৈর্য্য ধারণ; দুই, প্রিয় কুকর্ম থেকে বিরত থাকার ধৈর্য্য। এই দুই প্রকার ধৈর্য্যই মানুষের আত্মিক পরিপূর্ণতা, স্থায়িত্ব এবং সফলতার মূল ভিত্তি।

ধৈর্য্যের দুটি মাত্রা

ইমাম আলী (আ.) বলেছেন:

الصَّبْرُ صَبْرَانِ، صَبْرٌ عَلَی مَا تَکْرَهُ، وَ صَبْرٌ عَمَّا تُحِبُّ

ধৈর্য্য দুই প্রকার: এক, যা তোমার ভালো লাগে না, সেই কাজে ধৈর্য্য ধরে রাখা; দুই, যা তুমি ভালোবাস, কিন্তু তা থেকে বিরত থাকার ধৈর্য্য।

প্রথম প্রকার ধৈর্য্য মূলত ইবাদতের চ্যালেঞ্জ ও জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে স্থিতিশীল থাকার জন্য প্রয়োজন। দ্বিতীয় প্রকার ধৈর্য্য হলো প্রিয় কুকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখার ক্ষমতা। যদিও কিছু ব্যাখ্যাকারী মনে করেন প্রথম প্রকার দ্বিতীয়টির চেয়ে কঠিন, প্রকৃতপক্ষে উভয়ই মানুষের স্বভাব ও আত্মসংযমের ভিন্ন দিকের পরীক্ষা। কখনও ইবাদতের কঠিনতা বেশি, কখনও পাপ থেকে বিরত থাকার প্রয়াস কঠিন।

পরিপূর্ণতার পথে ধৈর্যের দীপ্তি

পরিপূর্ণতার পথে যাত্রা কখনোই সহজ নয়। এই পথ কেবল ফুলে মোড়ানো নয়—বরং ছড়িয়ে আছে পাথুরে বাধা, দুর্গম গিরিপথ, বিপজ্জনক প্রাণীর হুঙ্কার, প্রতিকূল পরিবেশের চ্যালেঞ্জ, আর আছে চোরাকারবারের ছায়া, যা বিভ্রান্ত করে পথিককে।

এই পথে এগিয়ে চলতে হলে চাই অটল ধৈর্য্য, চাই স্থায়িত্বের দৃঢ় ভিত্তি। যে হৃদয়ে ধৈর্য্য নেই, সে পথের মাঝেই হারিয়ে যায়; লক্ষ্য তার কাছে অধরা থেকে যায়, জয় তার কাছে কেবল কল্পনার ছায়া।

ধৈর্য্য—এ এক অলৌকিক শক্তি, যা কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নয়, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি উদ্দেশ্য পূরণেও অপরিহার্য। এটি মানুষকে গড়ে তোলে, ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে দেয়, আর পরিপূর্ণতার দ্বারে পৌঁছাতে সহায়তা করে।

 কুরআন কারিমে বলা হয়েছে:

«(إِنَّ الَّذینَ قَالُوا رَبُّنَا اللّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَیْهِمُ الْمَلائِکَةُ أَلاّ تَخافُوا وَلا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتی کُنْتُمْ تُوعَدُونَ

যারা হৃদয়ের গভীর থেকে বলে— “আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ”, আর সেই বিশ্বাসে অটল থাকে, তাদের জন্য আকাশ থেকে নেমে আসে শান্তির দূতেরা—ফেরেশতাগণ।তারা বলে: “ভয় করো না, দুঃখিত হয়ো না। তোমাদের জন্য রয়েছে সেই জান্নাত, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিল। আসো, এই সুসংবাদ গ্রহণ করো— যেখানে শান্তি আছে, প্রশান্তি আছে, আর আছে চিরন্তন আনন্দ।

অন্যত্র বলা হয়েছে:

ফেরেশতাগণ প্রতিটি দ্বার দিয়ে স্বর্গবাসীদের কাছে প্রবেশ করে এবং বলে: তোমরা ধৈর্য্যশীল ছিলে, তুমি এক মহান প্রতিফলনের যোগ্য।

এই আয়াত এবং হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ও সফল মানুষ কেবল ধৈর্য্য এবং স্থায়িত্বের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা অর্জন করে। ফেরেশতাদের আশীর্বাদ ও আধ্যাত্মিক শান্তি পাওয়ার মূল শর্ত হলো ধৈর্য্য ধরে রাখা এবং সমস্ত বিপদ-বিপর্যয়েও স্থির থাকা।

উপসংহার

ধৈর্য্য শুধু কষ্ট ও অসুবিধা সহ্য করার নাম নয়; এটি হলো আত্মসংযম, নৈতিক দৃঢ়তা এবং পরিপূর্ণতার চাবিকাঠি। ইমাম আলীর শিক্ষায় আমরা শিখি, সত্যিকারের সফলতা ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে, প্রিয় কুকর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে এবং স্থায়িত্ব বজায় রাখতে হবে। ধৈর্য্যই হলো সেই শক্তি যা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য এবং চিরন্তন সফলতার পথে পরিচালিত করে।

পাদটীকা

১. সূরা ফুসছিলাত, আয়াত ৩০।
২. সূরা রাদ, আয়াত ২৩ ও ২৪।
৩. জ্ঞানময় বক্তব্যের উৎস: এই প্রবাদময় বাক্যটি মূলত গুরারুল হিকমাএ যেমন আছে, তেমনই উসুলে কাফিতে কিছু পার্থক্যের সঙ্গে উল্লেখ আছে এবং তুহাফুল উকুলএও গুরারুল হিকমাএর মতোই উল্লেখ করা হয়েছে। (নাহজুল বালাগা উৎস, খণ্ড ৪, পৃ. ৪৯)। সম্পূর্ণ নাহজুল বালাগা-তেও এই প্রবাদময় বাক্যটি ইমাম আলী (আ.) তার পুত্র মুহাম্মদ বিন হানফিয়ার প্রতি ওসিয়তের মধ্যে এসেছে এবং এতে একটি অতিরিক্ত অংশও রয়েছে:

«وَأَحْسَنُ مِنْهُ الصَّبْرُ عَمَّا حَرَّمَ اللَّهُ ـ عَزَّوَجَلَّ ـ عَلَیْکَ»
“এবং আল্লাহ (পরম শ্রদ্ধেয়) যা তোমার ওপর হারাম করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা ধৈর্য্য আরও উত্তম।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button