কুরআন মুখস্থ ও তেলাওয়াত—এগুলো শুধুই সূচনা; লক্ষ্য হলো গভীরভাবে বুঝে সেই অনুযায়ী জীবন সাজানো
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: কুরআন শুধু উচ্চারণ বা তেলাওয়াতের জন্য অবতীর্ণ হয়নি; বরং এটি এমন এক দিকনির্দেশনা, যা মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। মুখস্থ করা ও পাঠ করা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ আমল, তবে এগুলো কেবল এক অনিবার্য ভূমিকা—আসল লক্ষ্য হলো তাদাব্বুর (গভীরভাবে চিন্তা), ফাহম (বোঝা) এবং আমল (আচরণে রূপ দেওয়া)। তাদাব্বুর ছাড়া মানুষ কখনোই আল্লাহর প্রকৃত বার্তা গ্রহণ করতে পারে না এবং কুরআনের সঙ্গে তার সত্যিকারের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে না।
কুরআনুল কারীম নিজেই বারবার চিন্তা ও উপলব্ধির আহ্বান জানায়। আল্লাহ তাআলা সূরা মুহাম্মদ-এর ২৪ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন—
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
“তারা কি কুরআনের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলো তালাবদ্ধ?” (সূরা মুহাম্মদ ২৪)
এই আয়াত আমাদের বুঝিয়ে দেয়—কুরআনের ওপর মনোযোগ না দেওয়া শুধু অবহেলা নয়, বরং হৃদয়ের ওপর অজ্ঞতা ও কপটতার তালা ঝুলে থাকার চিহ্ন। তাই যে ব্যক্তি তাদাব্বুর থেকে বঞ্চিত, সে মূলত আল্লাহর বার্তা গ্রহণের যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কেরাম বারবার কুরআন বোঝা ও তা অনুযায়ী জীবন গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শুধুমাত্র তেলাওয়াত করে চলে যাওয়া, কোনো কিছু না বুঝে, এমন যেন একটি ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা—কিন্তু রং, আবেগ বা অর্থ কিছুই অনুভব না করা। বাহ্যিক সৌন্দর্য বোঝা গেলেও তার প্রকৃত মূল্য অজানাই থেকে যায়।
তাদাব্বুর বলতে কী বোঝায়?
‘তাদাব্বুর’ অর্থ হলো — কোনো বিষয়ের ফলাফল, উদ্দেশ্য ও অন্তর্নিহিত শিক্ষা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। কুরআনের ক্ষেত্রেও এ-ই প্রযোজ্য; পাঠককে জানতে হবে—আল্লাহ এই আয়াতের মাধ্যমে আমাকে কোন শিক্ষা দিচ্ছেন? এটি আমার জীবন, চরিত্র, সমাজ—কোথায় প্রয়োগ করা উচিত?
অনেক আয়াত ওপর দেখলে সহজ মনে হয়, কিন্তু যখন চিন্তা করে পড়া হয়, তখন তার গভীরে লুকানো জ্ঞান ও হেদায়েত উন্মোচিত হয়। যেমন সূরা ফাতিহা—আমরা প্রতিদিন নামাজে বারবার পড়ি:
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক।
এই বাক্য শুধু প্রশংসা নয়—বরং এটি ঘোষণা করে যে এই বিশ্বে যা কিছু আছে, সবকিছুই আল্লাহর তত্ত্বাবধানে। প্রতিটি নেয়ামত তাঁর দান; তাই আমাদের সিদ্ধান্ত, আশা, ভয়—সবকিছুই তাঁর ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত।
যখন কেউ এই আয়াত নিয়ে গভীরভাবে ভাবে, তখন তার জীবনযাত্রা বদলে যায়। সে বুঝতে পারে—আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোনো দিন কোনো পরিকল্পনা বা প্রয়াস সফল হতে পারে না।
আল্লাহর রবুবিয়্যাত ও তাঁর ক্ষমতার নিদর্শনসমূহ
রব্বুল আলামিন” শব্দে ব্যবহৃত “রব্ব” শব্দটির গভীর অর্থ রয়েছে। রবুবিয়্যাত অর্থ হলো পালন-পোষণ, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও ধাপে ধাপে পরিপূর্ণতার দিকে পৌঁছে দেওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ কেবল সৃষ্টিকর্তা নন; বরং তিনি সমস্ত সৃষ্টির প্রতিটি অঙ্গ, প্রতিটি প্রক্রিয়া এবং প্রতিটি পরিবর্তনের তত্ত্বাবধায়ক।
মানুষের ভ্রূণের ধাপে ধাপে বিকাশ, প্রকৃতির চক্র, উদ্ভিদ ও প্রাণীর সুসংগঠিত জীবনযাপন—এসব কিছুই আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শন। গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়—এই দুনিয়ায় কিছুই ঘটনাচক্রে ঘটে না, বরং প্রতিটি কিছুর পেছনে রয়েছে এক পরম জ্ঞানী সত্তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
রবুবিয়্যাতের এই উপলব্ধি মানুষের মনে এ বিশ্বাস জাগায় যে—জীবনের কোনো দরজা আসলে বন্ধ নয়; সবই আল্লাহর ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই যার অন্তরে রবুবিয়্যাতের সঠিক উপলব্ধি তৈরি হয়, তার মনে হতাশা বা নিরাশার কোনো স্থান থাকে না। সে জানে—তার জীবনের উন্নতি, অগ্রগতি এবং প্রকৃত সাফল্য আল্লাহর হাতেই নিহিত।
এছাড়াও রবুবিয়্যাতের ধারণা মানুষকে শিখিয়ে দেয়—জীবনের প্রতিটি কল্যাণ, সাফল্য, সুস্বাস্থ্য কিংবা সৌন্দর্য—সবই আল্লাহর দান। তাই বরকত পেতে হলে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে, এবং নিজের প্রয়াসকে তাঁর বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালনা করতে হবে।
তাদাব্বুর, বুঝা ও আমল — কুরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গঠনের তিন স্তম্ভ
কুরআন হলো আল্লাহর সরাসরি বার্তা। এটি শুধু পড়া বা মুখস্থ করার জন্য নয়—বরং বোঝা, উপলব্ধি করা এবং জীবন গঠনের পথ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য।
আল্লাহ তাআলা সূরা তাওবার ১২২ নম্বর আয়াতে বলেন—
فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ
“তাদের প্রত্যেক দলের মধ্য থেকে কেন না কিছু লোক বের হয়, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে…” (সূরা আত-তাওবা ১২২)
এই আয়াত স্পষ্টভাবে বলে দেয়—কুরআন বোঝা ও তার আলোকে জীবন গঠন করা একটি সম্মিলিত দায়িত্ব।
যদি কেউ পুরো রমজান মাসে সম্পূর্ণ কুরআন পড়ে, কিন্তু একটি আয়াতও বুঝে না—তাহলে তার অবস্থা এমন যেন সে আল্লাহর কাছ থেকে চিঠি পেয়েছে, কিন্তু তা খোলারও চেষ্টা করেনি। অপরদিকে কেউ যদি মাত্র একটি পৃষ্ঠা গভীরভাবে পড়ে, বুঝে এবং জীবনে প্রয়োগ করে—তাহলে সে সত্যিকারের কুরআনের হক আদায় করেছে এবং হেদায়েতের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
সুতরাং, প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব হলো—কুরআন শুধু পড়া নয়, বরং বোঝা এবং বোঝার পর জীবন গঠনের উপযোগী করে তোলা। এটাই কুরআনের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং এভাবেই এর সঙ্গে হৃদয়ের বন্ধন গড়ে ওঠে।কুরআনের সঙ্গে সত্যিকার হৃদ্যতা গড়ে তুলতে হলে তিনটি জিনিস অপরিহার্য:
১- তাদাব্বুর — অর্থাৎ গভীরভাবে চিন্তা ও অনুধাবন
২- ফাহম (বোঝা) — অর্থাৎ উদ্দেশ্য ও বার্তা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা
৩- আমল — অর্থাৎ সেই আলোকে জীবনকে সাজিয়ে নেওয়া
এই তিনটি ধাপ মিলেই কুরআন মানুষের জীবনকে আলোকিত করে এবং তাকে প্রকৃত সাফল্য ও পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।



