বিশ্বইতিহাসধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদ

কেন ইরান ফিলিস্তিনের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ‘নিউইয়র্ক ঘোষণা’ ভোটে অংশ নেয়নি?

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গত শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ফিলিস্তিনের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সমর্থনে “নিউইয়র্ক ঘোষণা” অনুমোদন করেছে। তবে ইরান এ ভোটে অংশ নেয়নি। তেহরান জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্দেশে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছে, এই ঘোষণায় সংকটের মূল কারণ উপেক্ষা করা হয়েছে, দায়িত্বকে বিকৃত করা হয়েছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার—বিশেষত ন্যায্য আত্মরক্ষার অধিকার—বাতিল করা হয়েছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটে, ফ্রান্স ও সৌদি আরবের প্রস্তাবে উপস্থাপিত এই প্রস্তাবটি ১৪২ ভোটে অনুমোদিত হয়; ১০ দেশ বিরোধিতা করে এবং ১২ দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। “নিউইয়র্ক ঘোষণা” সাত পৃষ্ঠার একটি দলিল, যা জুলাই মাসে জাতিসংঘ সদর দফতরে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফলাফল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই সম্মেলন বর্জন করেছিল। প্রস্তাবটি এক দিন পর অনুমোদিত হলো, যখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছিলেন যে কখনও কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত হবে না।

 কেন ইরান ভোটে অংশ নেয়নি?

এই ভোটে ইরানের অনুপস্থিতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে অন্যতম প্রধান সমর্থক দেশ হিসেবে পরিচিত ইরানের এই পদক্ষেপকে কেউ কেউ জাতিসংঘে ইসলামি বিশ্বের মূল ইস্যুতে তেহরানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন হিসেবে তুলেছেন।

ইরানের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট: টেকসই ও প্রকৃত শান্তি কেবল তখনই সম্ভব, যখন ফিলিস্তিনি জনগণের ঐতিহাসিক ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার স্বীকৃত হবে। গত চার দশক ধরে তেহরান বারবার ঘোষণা করেছে যে তথাকথিত “দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান” কেবল ব্যর্থই নয়, বরং সংকটের মূল কারণকে উপেক্ষা করে বর্তমান দখলদারিত্ব ও সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী করে।

 ইরান মনে করে, ফিলিস্তিনে জায়নিস্ট প্রকল্প আসলে পশ্চিম এশিয়ায় একটি বৃহত্তর ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার অংশ। দখল, প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ ও পরিকল্পিত জাতিগত নিপীড়নের মাধ্যমে জায়নিস্ট শাসন যে নীতি চালাচ্ছে, তা যেকোনো ন্যায্য শান্তির ভিত্তিকে ধ্বংস করছে। তেহরানের মতে, দায়িত্বকে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত উভয়ের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হলো এক ধরনের বাস্তবতার বিকৃতি। বাস্তবে, আট দশকের দখল, গণহত্যা ও মৌলিক অধিকার হরণের মূল দায় ইসরায়েলের উপরই বর্তায়।

ইরানের বিকল্প প্রস্তাব

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ইরান জাতিসংঘে একটি বিকল্প সমাধান নিবন্ধিত করেছে—”ফিলিস্তিনের মূল বাসিন্দাদের মধ্যে জাতীয় গণভোট”, যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি সবাই অংশ নেবে। তেহরান এটিকে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সমাধান হিসেবে বিবেচনা করে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেয়ি, ২০১১ সালে ফিলিস্তিন ইন্তিফাদার সমর্থনে আয়োজিত সম্মেলনে বলেন,

“আমাদের দাবি হলো পুরো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, কেবল কোনো অংশ নয়। যে কোনো পরিকল্পনা যা ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করতে চায় তা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান আসলে জায়নিস্টদের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকারের পায়মালকরণ।”

প্রায় ১৫ বছর আগে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে চার ধাপের একটি গণতান্ত্রিক পরিকল্পনা উত্থাপন করে:

১. ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিজ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন,

২. মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সমন্বয়ে গণভোটের আয়োজন,

৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠন,

৪. এবং অবশেষে, নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্যদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ, যারা প্রকৃত ফিলিস্তিনি অধিবাসী নয়।

ইরানের অনুপস্থিতির ব্যাখ্যা

ইরান সাধারণ পরিষদের এই ভোটে অংশ না নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছে, প্রস্তাবিত ঘোষণায় ফিলিস্তিন সংকটের প্রকৃত শিকড় উপেক্ষা করা হয়েছে এবং কোনো বাস্তবসম্মত সমাধান দেওয়া হয়নি। ঘোষণায় দখলদারিত্ব, জায়নিস্টদের অপরাধ ও অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার মূল কারণ ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।

তেহরান জোর দিয়ে বলেছে, সংকটের দায়ভার ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা একটি বাস্তবতার বিকৃতি। কারণ, পশ্চিমা শক্তির প্রত্যক্ষ সমর্থনে ইসরায়েলই হলো অপরাধী পক্ষ, যারা জাতিগত নিপীড়ন, যুদ্ধাপরাধ ও বর্ণবাদী নীতি চালাচ্ছে। আরও উল্লেখযোগ্য হলো—ঘোষণার লেখকরা এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল নিজেরাই দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

 ইরানের মতে, ঘোষণায় ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর ঘটনাগুলোর বর্ণনা একপেশে ও বিভ্রান্তিকর। বাস্তবে, এই ঘটনার মূল পটভূমি হলো ৮০ বছরের দখলদারিত্ব, সহিংসতা ও ঔপনিবেশিক নীতি। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত বৈধ আত্মরক্ষা, অথচ ঘোষণায় সেটি অস্বীকার করা হয়েছে।

 মূল আপত্তি

ইরান বিশেষভাবে আপত্তি জানিয়েছে ঘোষণার দুটি দিকের প্রতি:

১. ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর নিরস্ত্রীকরণের দাবি, যা প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র ও অসহায় করে দেবে।

২. ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামো নির্ধারণে বাইরের হস্তক্ষেপ, যা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

 এছাড়া, ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে, যা ইরানের মতে একটি স্থায়ী আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর জন্য অপরিহার্য।

উপসংহার: ইরান স্পষ্ট করেছে যে অন্যায্য, বর্ণবাদী ও অধিকারের ভিত্তি উপেক্ষা করা কোনো সমাধান স্থায়ী হবে না। বরং তা সংকটকে দীর্ঘায়িত করবে এবং পশ্চিম এশিয়ার অস্থিতিশীলতা বাড়াবে।

সুতরাং, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের “নিউইয়র্ক ঘোষণা” ভোটে অংশ না নিয়ে ইরান আবারও তার নীতিগত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে— ইসরায়েলি দখলদারিত্বই হলো মূল সংকট, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান নয়; প্রকৃত সমাধান হলো মূল ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের গণভোট এবং তাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান।

 

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button