ধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

প্রেমের সত্তর স্তর: ইমাম আলী (আ.)-এর আধ্যাত্মিক দর্শন

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: একজন বেদুইনের প্রশ্নে ইমাম আলী (আ.) উন্মোচন করলেন প্রেমের রহস্যময় সোপান—যেখানে ইবাদতের বিনয়, আত্মসমালোচনা ও জবাবদিহিতার চেতনা হয়ে ওঠে প্রেমিকের প্রথম ধাপ,আর তার পরবর্তী স্তরগুলো আল্লাহর প্রেমে মিশে যাওয়ার সত্তরটি আধ্যাত্মিক যাত্রাপথ।

 এক বেদুইনের প্রশ্ন, এক অনন্ত উত্তর

মুস্তাদরাক আল-ওয়াসাইল-এর বর্ণনায় এসেছে—একদিন এক বেদুইন ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে এসে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন, প্রেমিকদের মর্যাদা কত প্রকার? ইমাম (আ.) তাঁর গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন—

প্রেমের সর্বনিম্ন স্তর হলো এই: যে ব্যক্তি নিজের ইবাদতকে তুচ্ছ জ্ঞান করে,
পাপকে মনে করে অত্যন্ত গুরুতর, এবং বিশ্বাস করে যে দুনিয়া ও আখেরাতে
সে-ই একমাত্র নিজের আমলের জবাবদিহি করবে। এই কথা শুনে বেদুইন গভীর আধ্যাত্মিক আলোড়নে অচেতন হয়ে পড়লেন। যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে এলো, তখন তিনি কাঁপা কণ্ঠে বললেন, হে ইমাম, এর চেয়েও কি উচ্চ স্তর রয়েছে? ইমাম আলী (আ.) তখন এক রহস্যময় শান্ত হাসি হেসে বললেন— হ্যাঁ, প্রেমের আরও সত্তরটি স্তর রয়েছে।

প্রেমিকের প্রথম ধাপ: বিনয় ও জবাবদিহি

ইমাম আলী (আ.)-এর এই বাণী প্রেমের এক ব্যতিক্রমী তত্ত্ব প্রকাশ করে—
যেখানে প্রেমের শুরুই হয় আত্মনম্রতা ও দায়বোধের বোধ দিয়ে। সত্যিকারের প্রেমিক কখনো নিজের ইবাদতে অহংকার খোঁজে না; বরং সে অনুভব করে তার সমস্ত আমলই তুচ্ছ, আর প্রতিটি ভুলই অমার্জনীয় দায়। তার হৃদয় সর্বদা পরিপূর্ণ থাকে তাওবা, ভয় ও আশা-র এক পবিত্র ভারসাম্যে।

কুরআনের দৃষ্টিতে প্রেম ও বিনয়

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন—

إِنَّ الَّذِينَ هُم مِّنْ خَشْيَةِ رَبِّهِم مُّشْفِقُونَ”
“যারা তাদের প্রভুর ভয়ে উদ্বিগ্ন থাকে।” (সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত ৫৭)

আরেক জায়গায় বলেন—

“وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوا وَّقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَىٰ رَبِّهِمْ رَاجِعُونَ”
যারা দান করে, ইবাদত করে, অথচ তাদের হৃদয় ভীত থাকে এই ভেবে—
যে তারা অবশ্যই তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে।”
(সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত ৬০)

এই আয়াতগুলো যেন ইমাম আলী (আ.)-এর কথার প্রতিধ্বনি—
প্রেমিক সেই, যে নিজের বিনয়কে ইবাদতের চূড়ান্ত রূপে পরিণত করে।

সত্তরটি স্তর: প্রেমের আধ্যাত্মিক সিঁড়ি

ইমাম আলী (আ.) যখন বললেন “সত্তরটি স্তর”, তখন তিনি সংখ্যার সীমা নয়, বরং গভীরতার প্রতীক বোঝালেন। এ সত্তর ধাপ মানে—আত্মা যতই পরিশুদ্ধ হয়,ততই প্রেমিক আল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছায়,যতক্ষণ না সে নিজের অস্তিত্বকেই হারিয়ে ফেলে আল্লাহর অস্তিত্বে।এখানেই প্রেমের চূড়ান্ত সত্য: যে নিজেকে ছোট মনে করে, সে-ই আল্লাহর কাছে বড়।

প্রেমের শিক্ষা: বিনয়, আত্মসমালোচনা ও জবাবদিহি

ইমাম আলী (আ.)-এর এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর হাদিস আমাদের শেখায়—প্রেম কোনো আবেগ নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন,যেখানে প্রথম ধাপই হলো আত্মসমালোচনার ক্ষমতা।প্রেমিক সেই, যে নিজের আমলকে ছোট মনে করে,
নিজের ত্রুটিকে বিশাল মনে করে,এবং আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদে বিনীত হৃদয়ে।

প্রেমের সিঁড়ি অনন্ত

ইমাম আলী (আ.)-এর উত্তর বেদুইনের প্রশ্নের মধ্যেই রেখে গেল এক অনন্ত তত্ত্ব—প্রেমের সিঁড়ি সত্তর নয়, অসীম। প্রতিটি ধাপে মানুষ নিজেকে হারায়, আর খুঁজে পায় আল্লাহকে।

সূত্র: Mustadrak al-Wasāʾil
কুরআনের রেফারেন্স:

১.সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত ৫৭

২.সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত ৬০

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button