কেন ‘তুফানুল আকসা’ শুরু হয়েছিল? গাজার কাদামাটির ফাঁদে পড়েছে দম্ভী ইসরায়েলি সেনাবাহিনী
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৭ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: দুই বছর আগে সংঘটিত তুফানুল আকসা অভিযান নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক মোড় ও বিশ্বপরিবর্তনকারী ঘটনা ছিল—যা কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই অভিযান ছিল এমন এক বাস্তবতা যা তথাকথিত শক্তিশালী ও অপরাজেয় ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার মুখোশ উন্মোচন করে দেয় এবং এর পতনের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে তোলে।
ঐতিহাসিক অভিযান
দুই বছর আগে, ৭ অক্টোবর সকালে, এমন এক ঘটনা ঘটেছিল যা আজও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথে সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে বিবেচিত হয়—ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের “তুফানুল আকসা অভিযান”।
এটি ছিল কেবল একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়; বরং বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল এক অস্তিত্বগত চ্যালেঞ্জ, যা ইসরায়েলি দখলদার শাসনের ভিত্তিমূল নাড়িয়ে দিয়েছে।
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর ঐতিহাসিক বক্তব্য
এই ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে হিজবুল্লাহর প্রয়াত নেতা শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই বলেন, “আমার বলার প্রয়োজন নেই, ৭ অক্টোবর কী ঘটেছিল। এটি ছিল এক বীরত্বপূর্ণ, সৃজনশীল ও অভূতপূর্ব অভিযান—যা নিরাপত্তা, সামরিক, রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে ইসরায়েলের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
এই অভিযান এক বিশাল ভূমিকম্পের মতো ছিল, যার প্রভাব এই দখলদার শাসনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয়ের ওপর পড়েছে এবং পড়তেই থাকবে। শত্রু সরকারের যা কিছু পদক্ষেপই থাকুক না কেন, তারা কখনোই ‘তুফানুল আকসা’র ঐতিহাসিক ও কৌশলগত প্রভাব মুছে ফেলতে পারবে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সবাই এই অভিযানের প্রশংসা করেছি—এটি প্রতিরোধের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।”
ইসরায়েলি শক্তির ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া বহুমাত্রিক আঘাত
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. মুহাম্মদ সাদিক খোরসান্দ বলেন, “গাজার মানবিক বিপর্যয় ও গণহত্যার অভিযোগ বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘও মার্কিন ও পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, মানবিক দিকের আড়ালে যেন ৭ অক্টোবরের কৌশলগত তাৎপর্য আড়াল না হয়।”
তার মতে, ওই দিন ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা কাঠামো এমন গভীর আঘাত পায় যে, তা থেকে পুনরুদ্ধার করতে তাদের দশকের পর দশক সময় লাগবে। “তুফানুল আকসা’র আগে ও পরে ফিলিস্তিন প্রশ্নকে আলাদা যুগে ভাগ করা যায়,” বলেন তিনি।
গোয়েন্দা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার পতন
খোরসান্দ আরও ব্যাখ্যা করেন, “ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে একটি ‘অভেদ্য দুর্গ’ হিসেবে উপস্থাপন করত—যেখানে বিশ্বের আধুনিকতম গোয়েন্দা সংস্থা, স্যাটেলাইট নজরদারি ও সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ৭ অক্টোবরের ঘটনায় এসবই ভেঙে পড়ে। মোসাদ ও শিন বেত—এই দুই প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার পরিপূর্ণ ব্যর্থতা শুধু একটি গোয়েন্দা ত্রুটি নয়, বরং এটি ছিল এক কৌশলগত পতন।”
হামাস যোদ্ধারা স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে, এমনকি প্যারাগ্লাইডারের মাধ্যমে দখলকৃত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এটি “অপরাজেয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী”র মিথ ভেঙে দেয় এবং তাদের তথ্য-প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে চূর্ণ করে।
এই ঘটনাই লেবাননের হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে নতুন করে সাহস জোগায়। ফলে ইসরায়েলকে উত্তরাঞ্চলের ডজনাধিক শহর খালি করতে হয় এবং এখন তারা এক বহুমুখী, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে।
গাজার কাদামাটির ফাঁদে ইসরায়েলি সেনারা
খোরসান্দ স্মরণ করিয়ে দেন, “অভিযানের প্রথম দিকে নেতানিয়াহু গাজায় আক্রমণ চালিয়ে দুইটি লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন—এক, হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা; দুই, সব জিম্মিকে মুক্ত করা। কিন্তু দুই বছর পরও সে দুটি লক্ষ্যই পূরণ হয়নি।”
তিনি যোগ করেন, “তারা এখনো ব্যর্থ। হামাসের কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা—শহুরে গেরিলা যুদ্ধ, টানেল-নেটওয়ার্ক ব্যবহার, ও দ্রুত আঘাতের কৌশল—ইসরায়েলি বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। বিশাল ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের পরও হামাসের সংগঠন এখনো টিকে আছে। এর ফলে ইসরায়েলের ভেতরেও সেনাবাহিনীর দক্ষতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।”
কেন ‘তুফানুল আকসা’ শুরু হয়েছিল?
সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আলী মুদাররেসি এ প্রশ্নের উত্তরে লেখেন, “অভিযান শুরুর পর থেকেই মিডিয়া ও সাধারণ মানুষ জানতে চায়—হামাস কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? এত মানবিক মূল্য দেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? এই প্রশ্নগুলো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বোধগম্য, কিন্তু উত্তর পেতে হলে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে।”
তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, গাজায় ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ, অর্থনৈতিক ধ্বংস, চরম বেকারত্ব এবং জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ৮০ শতাংশ জনগণ মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল—এই বাস্তবতাই এক গভীর হতাশা তৈরি করেছিল।
এছাড়া, পশ্চিম তীরে হত্যাকাণ্ড, গ্রেপ্তার ও দখল অব্যাহত ছিল, অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ছিল কার্যত নীরব।
এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের “আব্রাহাম চুক্তি” ফিলিস্তিন প্রশ্নকে সম্পূর্ণভাবে প্রান্তিক করে দিচ্ছিল। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে, ফিলিস্তিন নামটি ইতিহাস থেকেই মুছে যেত।
তাই মুদাররেসির মতে, তুফানুল আকসা কোনো তাৎক্ষণিক আবেগ নয়, বরং একটি কৌশলগত প্রতিক্রিয়া—যার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিন ইস্যুকে আবারও বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনা এবং স্বাভাবিকীকরণের ঢেউ থামানো।
মানবিক জাগরণের ঢেউ
মুদাররেসি -আরও লেখেন, “এই অভিযানের পর সারা বিশ্বে মানবিক জাগরণ দেখা দিয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার রাজধানীগুলোতে লাখো মানুষের বিক্ষোভ, ‘আস-সুমুদ’ (অটলতা) নামে শান্তিপূর্ণ মানবিক নৌ-কারাভান—সবই দেখিয়ে দিয়েছে যে গাজার কণ্ঠস্বর আবারও বিশ্ব শুনছে।”
তার ভাষায়, “তুফানুল আকসা যদি বড় কোনো মূল্যও দাবি করে থাকে, তবু এটি প্রতিরোধ ও দখলের সমীকরণকে বদলে দিয়েছে। এটি কেবল সামরিক অভিযান নয়; বরং এক ঐতিহাসিক মোড়, যা ফিলিস্তিনি জাতির ইচ্ছাশক্তি ও দখলদার শাসনের প্রকৃত মুখ বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত করেছে।”
ইসরায়েলের অর্থনৈতিক পতন ও অভ্যন্তরীণ সংকট
প্রতিবেদনের শেষাংশে বলা হয়, নেতানিয়াহু সরকার জিম্মিদের উদ্ধার করতেও ব্যর্থ, হামাসকে ধ্বংস করতেও নয়। বরং যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব এখন ইসরায়েলের জন্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
গাজা যুদ্ধে দশ-বিশ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ব্যয়, তিন লক্ষাধিক রিজার্ভ সেনা ডাকা, এবং উৎপাদনশীল খাত থেকে দক্ষ শ্রমশক্তি সরিয়ে নেওয়ার ফলে ইসরায়েলের “উদ্ভাবননির্ভর অর্থনীতি” মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর পরিণতি স্পষ্ট—
- জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া,
- বিদেশি বিনিয়োগের পতন,
- এবং বড় অঙ্কের পুঁজি বিদেশে পাচার।
এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধাক্কা ইসরায়েলি সমাজে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, যা এখনো চলমান।
তুফানুল আকসা ছিল এমন এক অধ্যায়, যা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ ইতিহাসকে নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে এবং ইসরায়েলি দখলনীতির ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। দুই বছর পরও এর অভিঘাত—রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক—সব দিক থেকেই স্পষ্ট।



