জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

অক্ষয় ধন: যার ক্ষয় নেই কোনোদিন

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: যতই ধন-দৌলতের পাহাড় গড়ে তুলুক মানুষ, স্বজনের স্নেহ-ছায়া ও সাহায্যের হাত থেকে সে কখনোই মুক্ত নয়। সিলাতুর রাহিম—আত্মীয়তার সেতুবন্ধন—শুধু একটি সামাজিক আচার নয়, বরং হৃদয়ের গভীরে জ্বলতে থাকা এক অক্ষয় আলো, যা মানুষকে নিরাপত্তার আশ্রয় দেয়, পরিচয়ের শেকড় মজবুত করে এবং জীবনকে স্থায়ী অর্থে ভরিয়ে তোলে। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আ.) সেই সত্যের স্ফটিক-স্বচ্ছ আয়না ধরে বলেছেন— “যে নিজের হাত আত্মীয়দের দিক থেকে গুটিয়ে নেয়, সে কেবল একটি হাত সরিয়ে নেয়; কিন্তু তার বদলে বহু হাত তার কাছ থেকে চিরতরে সরে যায়।

ইরানি সমাজ থেকে শুরু করে সমস্ত ইসলামী সভ্যতায় সিলাতুর রাহিম এক পবিত্র ও মহিমান্বিত জীবনমূল্য। এটি কেবল ঈদ-পার্বণে দেখাসাক্ষাৎ বা ফোনের “কেমন আছো?” নয়; এটি হৃদয়ের গভীরে বোনা এক অলঙ্ঘ্য সুতো, যা মানুষকে মানুষের সঙ্গে, প্রজন্মকে প্রজন্মের সঙ্গে, অতীতকে ভবিষ্যতের সঙ্গে জুড়ে রাখে।

পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ সমাজের মেরুদণ্ডের মতো। এই বন্ধনই গড়ে তোলে আবেগের এক অটুট জাল—বিপদে যে জাল আশ্রয় দেয়, আনন্দে যে জাল আলোকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আজকের এই যান্ত্রিক যুগে যখন মানুষ একে অপরের থেকে হাজার মাইল দূরে সরে যাচ্ছে, তখন এই পারিবারিক সুতোই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা কোথা থেকে এসেছি, কার রক্ত আমাদের শিরায় বইছে।

আমীরুল মু’মিনীন (আ.) নাহজুল বালাগায় সেই চিরন্তন সত্য উচ্চারণ করেছেন: «هَيْهَاتَ أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّهُ لَا يَسْتَغْنِي الرَّجُلُ وَإِنْ كَانَ ذَا مَالٍ عَنْ عَشِيرَتِهِ…» “হে মানুষ! যত ধনীই হোক কেউ, সে কখনো নিজের পরিবার ও স্বজনের থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করতে পারে না। তারাই তাদের হাত ও জিহ্বা দিয়ে তাকে রক্ষা করে; তারাই তার অনুপস্থিতিতে তার সম্মানের পাহারা দেয়; তারাই বিপদের কালো মেঘে সর্বাগ্রে ছায়া হয়ে দাঁড়ায়। যখন দুর্যোগ নেমে আসে, তাদের হৃদয়ই সবচেয়ে কোমল, তাদের সহানুভূতিই সবচেয়ে গভীর। আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন সত্যবাক্য ও সুনাম—এই দুটি এমন সম্পদ, যা সোনা-রুপার চেয়েও উত্তম, কারণ সোনা-রুপা শেষ পর্যন্ত অন্যের হাতে চলে যায়।”

তারপর তিনি দৃঢ় কণ্ঠে সতর্ক করেন: «وَمَنْ يَقْبِضْ يَدَهُ عَنْ قَرَابَتِهِ فَإِنَّمَا تُقْبَضُ مِنْهُ يَدٌ وَاحِدَةٌ وَتُقْبَضُ عَنْهُ أَيْدٍ كَثِيرَةٌ…» “যে আত্মীয়দের দিক থেকে নিজের হাত গুটিয়ে নেয়, সে কেবল নিজের একটি হাত সরিয়ে নেয়; কিন্তু তার বদলে বহু হাত তার কাছ থেকে চিরতরে সরে যায়। আর যে কোমলতা ও স্নেহের সঙ্গে স্বজনদের সঙ্গে চলে, সে তাদের ভালোবাসাকে চিরকালের জন্য নিজের করে নেয়।”

এই বাণীর তিনটি স্তর

১. বাস্তব স্তর পরিবারই মানুষের প্রথম দুর্গ। বিপদে তারা ঢাল হয়ে দাঁড়ায়, দুঃখে তারা চোখের জল মোছে, সাফল্যে তারা হাততালি দেয়।

২. নৈতিক স্তর সত্যবাক্য ও সুনাম এমন সম্পদ যা ব্যাংকে জমা হয় না, মানুষের হৃদয়ে জমা হয়। আত্মীয়দের প্রতি দয়া ও সদাচরণই সেই সুনামের চাবিকাঠি।

৩. আধ্যাত্মিক স্তর যে হাত দিয়ে তুমি স্বজনের হাত ধরো, সেই হাতই কিয়ামতের দিন তোমার হাত ধরে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে।

ইরানি জীবনে সিলাতুর রাহিমের জীবন্ত ছবি

আনন্দে: বিয়ের আসরে শত শত আত্মীয়ের ভিড়, নবজাতকের আকিকার দিনে ঘর ভর্তি হাসি আর দোয়া—এই উপস্থিতিই আনন্দকে বহুগুণ করে।

শোকে: কারো মৃত্যুতে পুরো পরিবার এক হয়ে যায়। কেউ কাঁধে করে কফিন বয়, কেউ কবর খোঁড়ে, কেউ মায়ের কপালে হাত রেখে বসে থাকে। এখানে টাকা নয়, হৃদয়ের উপস্থিতিই সবচেয়ে বড় সম্পদ।

উপসংহার

সিলাতুর রাহিম শুধু একটি দ্বীনি দায়িত্ব নয়, এটি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বিনিয়োগ। যত বিলিয়ে দাও, তত বাড়ে। যত হাত ধরো, তত হাত তোমাকে ধরে রাখে। এই সম্পদ কখনো ফুরোয় না, বরং মানুষের মৃত্যুর পরও তার নামের সঙ্গে জ্বলতে থাকে।

তাই আজই ফোনটা তুলে নাও। যে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে, তাকে একটা “কেমন আছো?” পাঠাও। যে খালার জন্য দীর্ঘদিন দোয়া করোনি, তার জন্য একটি ফাতেহা পড়ো। কারণ এই ছোট হাত বাড়ানোই একদিন তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে ফিরে আসবে—একটি অক্ষয় ধন, যার নেই কোনোদিন।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button