নতুন প্রজন্মের একরূপ শালীন পোশাকবিধির প্রতি বিরোধ — যুক্তি, আকর্ষণ ও বৈচিত্র্যের মাধ্যমে সমাধান
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: একদল নারী স্বভাবগতভাবেই ধর্মীয় নীতি রীতি মেনে চলেন কিন্তু কিছু নারীর মধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। ধর্মীয় নীতির পরিপন্থী না হয়েও একরূপ পোশাকের জোরাজুরি নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিরোধ তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তরুণ সমাজের স্বাভাবিক বৈচিত্র্যপ্রিয় মানসিকতাকে উপেক্ষা না করে যুক্তি, নান্দনিকতা ও আধুনিক নকশার মাধ্যমে শালীন পোশাককে আকর্ষণীয় করে তোলাই সময়ের দাবি।
একঘেয়ে ধারণার বিপরীতে বৈচিত্র্যের দাবি
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম, যাদের মানসিক গঠন পরিবর্তন, বৈচিত্র্য ও ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের আকাঙ্ক্ষায় গঠিত, তারা এখন এমন একরূপ ও সীমিত পোশাকবিধির প্রতি প্রতিরোধ দেখাচ্ছে— এমনকি তা ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যেও থাকলেও।
ইরানের সমাজে শালীন পোশাক বা “পোশাক-এ-আফিফানা”-র প্রসারে যেভাবে কেবল একটি নির্দিষ্ট ধাঁচের পোশাক ও রঙকে শ্রেষ্ঠ রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটি নতুন প্রজন্মের মধ্যে দূরত্ব ও প্রতিরোধ তৈরি করেছে।
শালীন পোশাক: কেবল বাহ্যিক নির্দেশ নয়, এক নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শালীন পোশাক কোনো একক ও বাহ্যিক আদেশ নয়; বরং এটি এক বৃহৎ কোরআনিক নৈতিক কাঠামোর অংশ, যা সমাজে সুস্থ সম্পর্ক, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌন আচরণের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গঠিত।
এই কাঠামোর মূল উপাদানগুলো— তাকওয়া (খোদাভীতি), হায়া (লজ্জাশীলতা), আখলাক (নৈতিকতা) এবং আফিফাত (শালীনতা)— মানুষের অন্তর্নিহিত চরিত্রকে গঠন করে, যাতে নারী-পুরুষ উভয়ই সামাজিক জীবনে মর্যাদাপূর্ণভাবে অংশ নিতে পারেন।
এর উদ্দেশ্য হলো এমন এক সামাজিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে বিশেষত নারীরা সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিয়ে জনজীবনে অংশ নিতে পারেন, কোনো ধরনের হয়রানি বা ক্ষতির শিকার না হয়ে।
ইমাম মুসা সাদর-এর ব্যাখ্যা: ধর্ম নারীর সামাজিক উপস্থিতির বাধা নয়
প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ইমাম মুসা সাদর, লেবাননের খ্রিস্টান সাংবাদিক হানান মাআলুফ-এর এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“আমি মনে করি না যে হিজাব নারীর সামাজিক কার্যকলাপে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আজকের যুগে নারীর পোশাক তার নারীত্বকে এতটাই সামনে আনে যে, তার অন্যান্য প্রতিভা, যোগ্যতা ও দক্ষতাগুলি আড়াল হয়ে যায়। আমি মনে করি আধুনিক সভ্যতা নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা দিতে পারেনি। যদিও এটি স্বাধীনতার কথা বলে, বাস্তবে নারীকে বিজ্ঞাপন, বাণিজ্য ও উৎসবের মাধ্যমে আরও বেশি বদ্ধ করেছে। এতে নারীর জীবনের সুযোগ ও মর্যাদা সংকুচিত হয়েছে। যদি আমরা নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতা চাই, তবে ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই সেই পথ আছে। ইসলাম নারীর সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে না। যদিও পরিবার ও গৃহস্থালির দায়িত্বকে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু সেটি কোনো বাধ্যবাধকতা নয়।”

পোশাক: মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক
কোরআনের যুক্তি অনুযায়ী, পোশাক কেবল দেহ আড়াল নয়— এটি আত্মরক্ষা, পরিচয় ও মর্যাদার প্রতীক।
সূরা আহযাব (আয়াত ৫৯)-এ আল্লাহ বলেন,
“হে নবী! তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন নিজেদের ওপর চাদর টেনে নেয়। এতে তারা সহজে চিনে নেওয়া যাবে এবং কোনো কষ্ট বা হয়রানির শিকার হবে না।”
অর্থাৎ, হিজাব নারীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও আত্মসম্মানের প্রতীক। এটি তাকে সমাজে স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়, কারণ এটি সম্ভাব্য অশোভন দৃষ্টি ও আচরণের বিরুদ্ধে এক সুরক্ষা।
এখানে মনে রাখতে হবে— আফিফাত (শালীনতা) ও নজরনিয়ন্ত্রণ (নজর-এ-পাকদারি) উভয়ই নারী-পুরুষের জন্য সমান দায়িত্ব। সমাজে নৈতিক পবিত্রতা বজায় রাখা কোনো একক লিঙ্গের কাজ নয়।
শালীন পোশাক: স্বাধীনতার ঢাল, সীমাবদ্ধতার শৃঙ্খল নয়
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হিজাব নারীর স্বাধীনতাকে সীমিত করে না; বরং তাকে সামাজিক চাপ, যৌন বস্তুতে পরিণত হওয়া এবং অযাচিত দৃষ্টির শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি নারীর অন্তর্নিহিত স্বাধীনতা ও আত্মসম্মানের প্রতিরক্ষা দেয়— যেন সে নিজেকে আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপে নয়।
চ্যালেঞ্জ: একরূপতার জোরাজুরি ও নতুন প্রজন্মের প্রতিরোধ
যদিও শালীন পোশাকের ধর্মীয় ভিত্তি গভীর ও যুক্তিসঙ্গত, বাস্তবে সমাজে এটি প্রচারের ক্ষেত্রে নানা সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
একই রঙ, একই নকশা ও একই ফর্মে হিজাব বা শালীন পোশাক চাপিয়ে দেওয়া— এমনকি তা ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যেও হোক— আজকের প্রজন্মের বৈচিত্র্যপ্রিয় মানসিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে।
ফলাফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে, অনেক তরুণী ও তরুণ এই বাধ্যতামূলক একঘেয়েমিকে প্রত্যাখ্যান করছে, এবং তাতে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক প্রভাব তৈরি হচ্ছে না।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— পোশাক সব সময়ই পরিবর্তনশীল ও সংস্কৃতিনির্ভর। যেমন প্রাচীন ইরান, রোম বা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে মুসলিম পোশাকের বিবর্তন ঘটেছিল, তেমনভাবেই আজকের যুগেও নান্দনিক বৈচিত্র্য ও আধুনিকতা প্রয়োজনীয় বাস্তবতা।
বাস্তব চিত্র: আরাম, শালীনতা ও সৌন্দর্যের সমন্বয়
আজকের মুসলিম নারীরা বাস্তব প্রয়োজনের কারণে— যেমন গাড়ি চালানো, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ— এমন পোশাক বেছে নিচ্ছেন, যা একই সঙ্গে ঢেকে রাখে এবং ব্যবহারিকভাবে আরামদায়ক।
উদাহরণস্বরূপ, হাতা-যুক্ত চাদর, আধুনিক আবায়া, শালীন কিন্তু ফ্যাশনেবল পোশাক ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে।
এই প্রবণতা প্রমাণ করে— শালীনতার মূল উদ্দেশ্য রক্ষা করা সম্ভব, এমনকি আধুনিক রুচি ও প্রয়োজনের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ করেও।
যদি সংস্কৃতি একঘেয়ে ও স্থবির থাকে, তবে তরুণদের প্রাকৃতিক পরিবর্তনচেতনা বিদেশি সংস্কৃতি দ্বারা পূর্ণ হবে। ফলে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রতীকের আবেদন কমে যাবে।
তাই ইসলামি বিশ্বের অনেক দেশ যেমন রঙিন ও শালীন হিজাব, নান্দনিক আবায়া ও ফ্যাশন ডিজাইন ব্যবহার করছে, তেমনি আমাদের সমাজেও এই বৈচিত্র্য ও উদ্ভাবন গ্রহণ করা জরুরি।
পথের দিশা: যুক্তি, আকর্ষণ ও বৈচিত্র্যের সমন্বয়
অতীতের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হলে, এখন প্রয়োজন চিন্তাগত পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন। শালীন পোশাক প্রচার করতে হলে এটিকে একঘেয়ে বা শুষ্ক নির্দেশ হিসেবে নয়, বরং একটি রুচিসম্পন্ন, যুক্তিনির্ভর ও আত্মিক জীবনধারা হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।
দেশীয় ফ্যাশন ও পোশাক শিল্পকে এই মিশনে সক্রিয় হতে হবে— তারা যেন এমন পোশাক তৈরি করে যা একদিকে ধর্মীয় সীমা রক্ষা করে, অন্যদিকে আধুনিক রুচি, আরাম ও আকর্ষণও বজায় রাখে।
বৈচিত্র্যময় রঙ, নকশা ও স্টাইলকে স্বীকৃতি দিতে হবে— এটি শুধুই অনুমোদনের বিষয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক টিকে থাকার শর্ত।
তরুণদের জন্য যুক্তিসঙ্গত সংলাপ ও মানসিক গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই কেবল উপদেশ নয়, বরং খোলা আলোচনা, প্রশ্নোত্তর কর্মশালা, এবং নান্দনিকভাবে শালীন পোশাক ব্যবহারকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রেরণা তৈরি করতে হবে।
বাহ্যিক নির্দেশ নয়, এক সচেতন নির্বাচন
হিজাব বা শালীন পোশাক তখনই সফলভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন এটি বাহ্যিক বিধান নয়, বরং আন্তরিক বিশ্বাস, সচেতন নির্বাচন ও ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠবে।
নতুন প্রজন্মের রুচি, প্রয়োজন ও মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে, নকশা, রঙ ও উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য ও নবচিন্তা যুক্ত করতে পারলেই সমাজে শালীনতার সংস্কৃতি এক নতুন আকর্ষণীয় রূপে প্রতিষ্ঠা পাবে।



