বিশ্ববিশেষ সংবাদসংবাদ বিশ্লেষণ

আমেরিকা ও সৌদি আরবের সহায়তায় ‘আল-মাদখালি’ তাকফিরি গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ে ইরাকের সতর্কবার্তা

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইরাকের আলআনবার আলমুতাহিদ জোটের সদস্য হাতেম তাহা আল-দুলাইমি পশ্চিম বাগদাদের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে আবু গারিব অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক ‘আল-মাদখালি’ তাকফিরি গোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন যে, এ গোষ্ঠী ধীরে ধীরে ইরাকের অন্যান্য প্রদেশেও তাদের প্রভাব বিস্তার করার পরিকল্পনা করছে।

আল-দুলাইমি বলেন, মাদখালি গোষ্ঠী আবু গারিবকে তাদের কেন্দ্র বানিয়েছে। এখান থেকে তারা আনবার, সালাহউদ্দিন, নিনেভা এবং বাগদাদের বিভিন্ন অঞ্চলের মসজিদের মিম্বার দখল করে নিজেদের উগ্র চিন্তাধারা প্রচার করতে চাইছে। তিনি অভিযোগ করেন, এ তৎপরতা প্রভাবশালী ইরাকি রাজনীতিবিদদের সমর্থন এবং আমেরিকা ও সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চলছে, যার লক্ষ্য ইরাকের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা ভেঙে দেওয়া।

আল-দুলাইমি আরও বলেন:

১. মাদখালি গোষ্ঠী মূলত আইএসআইএল (দায়েশ)-এর নতুন সংস্করণ।

২. আপাতত তারা সরাসরি অস্ত্র ব্যবহার না করে সমাজিক প্রভাব ও প্রচারণার মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।

৩. তবে ভবিষ্যতে তারা জোরপূর্বক শক্তি প্রয়োগের পথেও যেতে পারে।

তিনি জানান, আবু গারিবে তাদের ব্যাপক উপস্থিতি মূলত রাজধানী বাগদাদ, আনবার, সালাহউদ্দিন ও নিনেভার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি।

আলমাদখালিগোষ্ঠী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

‘জামি’ বা ‘মাদখালি’ গোষ্ঠী এক ধরনের সালাফি মতবাদ, যা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে উপসাগরীয় দেশগুলোর শাসকদের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষত আমেরিকার সামরিক সহযোগিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠার পর আবির্ভূত হয়। এ গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—আরব শাসকদের সব আচরণের পক্ষে ধর্মীয় যুক্তি হাজির করা, ধর্ম ও নৈতিকতার আসল নীতি উপেক্ষা করে।

এই ধারা প্রথম শুরু হয় মদিনায় অবস্থানকারী মুহাম্মদ আমান জামি এবং তার পরবর্তী অনুসারী রাবি আল-মাদখালি-এর মাধ্যমে। তারা সৌদি শাসকদের আমেরিকার সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পক্ষে ধর্মীয় বৈধতা দিতে শুরু করেন।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও কিছু আরব শাসকের নিষ্ক্রিয়তা কিংবা সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে আবারও এ গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়ে গেছে।

মাদখালিরা নিজেদের একমাত্র প্রকৃত সালাফি দাবি করে এবং অন্য ইসলামি আন্দোলনকে প্রকাশ্যে শত্রু মনে করে। তারা এমনকি প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদদের (যেমন: আবুল আ’লা মওদূদী, হাসান আল-বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব, আবদুল্লাহ আজ্জাম, ইউসুফ আল-ক্বারদাভি) কঠোরভাবে আক্রমণ করে এবং তাদের ‘বিদ’আতকারী’, ‘ফাসেক’, ‘খারেজি’ বা ‘কাফের’ আখ্যা দেয়।

ইসলামী দেশগুলোতে বিস্তার

মাদখালি মতবাদ পরবর্তীতে সৌদি শাসকদের আনুকূল্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আরব বসন্ত-পরবর্তী সামরিক অভ্যুত্থানগুলোতেও এদের ব্যবহার করা হয়। ফলে এটি আরব স্বৈরাচারী শাসনগুলো হাতে ধর্মীয় বৈধতা প্রদানের একটি হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

সৌদি-আরব ও কাতারের দ্বন্দ্বের সময় মাদখালিরা কাতারের শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানায়। একই সময়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্টও এদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি।

ওয়াহাবিবাদের বিকল্প হাতিয়ার

গবেষণা সংস্থা মারসাদ থিংক ট্যাঙ্ক-এর মতে, পশ্চিমা গবেষণা কেন্দ্রগুলো প্রমাণ দিয়েছে যে, মাদখালিরা আসলে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তৈরি এক বিশেষ প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য ইসলামি আন্দোলন দমন এবং শাসকশ্রেণীকে ধর্মীয় বৈধতা প্রদান।

সালাফি আলেম ইয়াহইয়া আল-হাজ্জুরি এমনকি প্রকাশ করেন যে, রাবি আল-মাদখালির জামাতা সৌদি গোয়েন্দা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি অর্থের বিনিময়ে সহযোগিতা চেয়েছিলেন।

এ থেকে প্রমাণিত হয়—ওয়াহাবিবাদের দুর্নাম ও কার্যকারিতা হারানোর পর সৌদি শাসকরা নতুন হাতিয়ার হিসেবে মাদখালি গোষ্ঠীকে ব্যবহার করছে। তারা এমনকি হামাস ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকেও আক্রমণ করছে, যা সৌদি শাসকদের ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

উপসংহার

সৌদি আরবে মূলত কিছুই বদলায়নি। যেমনভাবে তারা দশক ধরে ওয়াহাবিবাদকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার বানিয়েছিল, এখন সেই কাজ করছে আরও অনুগত ও বিপজ্জনক মাদখালি মতবাদের মাধ্যমে। এমনকি ভবিষ্যতে তারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকেও ধর্মীয়ভাবে বৈধ প্রমাণ করার চেষ্টা করবে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button