সৃষ্টি শুরুর রহস্য সেই আয়াতে, যা পুরো পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ ১৩ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত শুধু অতীতের ঘটনা নয়; এটি আমাদের বর্তমান চিন্তার জন্য এক মানচিত্র। এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—বিশ্ব একটি লক্ষ্যভিত্তিক সৃষ্টির ফল, আকস্মিক নয়, এবং মানুষও সেই পরিকল্পনার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আকাশ ও জমিন যখন একত্র ছিল এবং আল্লাহর নির্দেশে আলাদা হয়েছিল, ঠিক তখন থেকেই জীবনের পথও তৈরি হতে শুরু করে।
কোরআন মজিদের সূরা আম্বিয়ার এক বিস্ময়কর আয়াতে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্য খুব সংক্ষিপ্ত অথচ গভীরভাবে তুলে ধরা হয়েছে—
«أَوَلَمْ یَرَ الَّذِینَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا» (سوره انبیاء؛ آیه 30)
যারা কুফর করল তারা কি দেখে না যে আসমানসমূহ ও জমিন একত্রিত এক অবস্থা ছিল, আর আমি তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিলাম?
এই আয়াত কোরআনের অন্যতম মূল ভিত্তি, যা সৃষ্টির উৎস সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টি নতুনভাবে খুলে দেয়। আল্লাহ তাআলা প্রশ্নের মাধ্যমে মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র বৃত্ত থেকে তুলে এনে মহাবিশ্বের সূচনার দিকে তাকাতে আহ্বান জানান। এখানে ‘رتق’ শব্দটি বোঝায় সংযুক্ত ও একীভূত অবস্থা, আর ‘فتق’ বোঝায় সেই বন্ধন ভেঙে আলাদা করে দেওয়া। ভাষার সরলতায় এবং ভাবের গভীরতায় মহাবিশ্বের সূচনাকে এমন সহজ অথচ শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন সত্যিই বিস্ময়ের।
শুরুতে একতা, তারপর বিস্তার
«کَانَتَا رَتْقًا» — এই বাক্যাংশ প্রমাণ করে যে সৃষ্টি-ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ে আকাশমণ্ডলী ও জমিন ছিল একত্র ও অবিচ্ছেদ্য। এরপর কোরআন বলে — «فَفَتَقْنَاهُمَا», যা নির্দেশ করে সেই সংহতি ভেঙে অসংখ্য রূপ ও বিস্তারের জন্ম হলো। কিন্তু এই বিচ্ছেদ নিছক কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাবলি নয় — বরং এটি আল্লাহর ইচ্ছা, জ্ঞান ও পরিকল্পনার এক সচেতন প্রকাশ।
কোরআনের ভাষায়, সৃষ্টি কোনো উদ্দেশ্যহীন বা আকস্মিক প্রক্রিয়া নয়। যেমন আরেক স্থানে বলা হয়েছে —
«اللَّهُ الَّذِی خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَیْنَهُمَا فِی سِتَّةِ أَیَّامٍ»
এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় — সৃষ্টির পথচলা একেবারেই লক্ষ্যনির্ভর; যেখানে ঐক্য থেকে বৈচিত্র্যে, স্থবিরতা থেকে জীবনের গতি উদ্ভাসিত হয়েছে।
সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত শুধু অতীতের বর্ণনা নয়; এটি আমাদের বর্তমান চিন্তার জন্য এক মানচিত্র। আকাশ ও জমিন যখন একত্র ছিল এবং আল্লাহর নির্দেশে আলাদা হয়েছিল, ঠিক তখন থেকেই জীবনের পথও তৈরি হতে শুরু করে। এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—বিশ্ব একটি লক্ষ্যভিত্তিক সৃষ্টির ফল, আকস্মিক নয়, এবং মানুষও সেই পরিকল্পনার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কৌতূহলের বিষয় যে, ইসলামী তাফসীরে, বিশেষ করে তাফসীর আল-মীজান-এ, “রাতক” (رتق) শব্দের অর্থ শুধু সংযুক্ত থাকা নয়; এটি এমন অবস্থাকে বোঝায় যখন আকাশ থেকে বর্ষা হয় না এবং জমিনে উদ্ভিদ জন্মায় না। ইমাম সাদিক (আ.) এক হাদিসে বলেন:
আকাশ বন্ধ ছিল, বর্ষা পড়ত না, এবং জমিনও বন্ধ ছিল, উদ্ভিদ জন্মাত না; তখন আল্লাহ আকাশকে বর্ষার মাধ্যমে খুললেন এবং জমিনকে উদ্ভিদের জন্ম দিয়ে সজীব করলেন।
এই বর্ণনা দেখায় যে ফাতক (فتق) শুধুমাত্র মহাজাগতিক স্তরে নয়, বরং পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যেও কার্যকর হয়েছে।
জীবনের সঙ্গে বিস্ময়কর সম্পর্ক: জল, সমস্ত জীবনের উৎস
সেই একই আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে:
وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَیْءٍ حَیٍّ
আমরা জলের মধ্য থেকে সব জীবন্ত সৃষ্টিকে উদ্ভূত করেছি।
এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বাক্যটি জীবনচক্রের চিত্র তুলে ধরে—যেখানে আকাশ ও জমিনের ফাটল এবং বিচ্ছেদের ঘটনা জীবনের উদ্ভবের সঙ্গে যুক্ত হয়। আদি বিচ্ছেদের পর পৃথিবী জীবনের জন্য প্রস্তুত হলো, এবং জল—সব জীবের উৎস—একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করল।
এটি আধুনিক বিজ্ঞানের জল ও জীবনের সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং আরও দেখায় যে জীবন কোনো দুর্ঘটনার ফল নয়; বরং এটি আল্লাহর পরিকল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার ফল। কোরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রথম জীবন্ত সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে আল্লাহর হাত সক্রিয়। প্রতিটি জলকণায় এবং জীবনের প্রতিটি নিদর্শনে মানুষ পায় অসীম শক্তি ও জ্ঞানের প্রতিফলন।
কোরআন ও বিজ্ঞানের সংলাপ
সূরা আম্বিয়ার আয়াত ৩০ অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী এবং কিছু পশ্চিমী গবেষকের মতে “বিশ্বের একক সূচনা”-এর ধারণার সঙ্গে অতি কাছাকাছি। বৈজ্ঞানিক বিগ ব্যাং (Big Bang) তত্ত্ব, যা বিশ্বের জন্মকে একটি সঙ্কুচিত ও একক অবস্থান থেকে বর্ণনা করে, তা কোরআনের “রাতক” (رتق) এবং “ফাতক” (فتق)-এর ব্যাখ্যার সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়।
কিন্তু কোরআনের লক্ষ্য কোনো ভৌত বিজ্ঞান শেখানো নয়। এর উদ্দেশ্য হলো মানব মন ও হৃদয়কে জাগ্রত করা, দেখানো যে সমস্ত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পেছনে এক সচেতন, জ্ঞানী ও করুণাময় স্রষ্টা রয়েছেন। আল্লাহ যিনি একটি “কুন” (হও)”-এর মাধ্যমে সৃষ্টিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন:
«إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَیْئًا أَنْ یَقُولَ لَهُ كُنْ فَیَكُونُ» (سوره یس؛ آیه 82)
“যদি তিনি কোনো কিছু চায়, তিনি শুধু বলেন—‘হও’, এবং তা হয়ে যায়।”
বিজ্ঞান আমাদের বলে ‘কিভাবে’ সৃষ্টি হলো, কিন্তু কোরআন আমাদের বলে ‘কেন’। বিজ্ঞান প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে, কোরআন অর্থ প্রকাশ করে।
চিন্তা ও বিশ্বাসের আহ্বান
এই আয়াতের মূল বার্তা হলো—সৃষ্টি ও জীবনের উদ্ভব আকস্মিক বা উদ্দেশ্যহীন নয়। প্রতিটি ফাটল, প্রতিটি সাজানো বিন্যাসে রয়েছে আল্লাহর ইচ্ছা। এটি মানুষকে দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়: আমরা কোনো ক্ষুদ্র, অপ্রাসঙ্গিক সত্তা নই; আমরা সৃষ্টির বিশাল পরিকল্পনার অংশ। আমাদের উচিত এই অর্থ উপলব্ধি করে নিজের স্থান ও কর্তব্য চেনা।
কোরআন বারবার মানুষকে চিন্তাশীল হতে আহ্বান জানিয়েছে:
«إِنَّ فِی خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّیْلِ وَالنَّهَارِ لَآیَاتٍ لِأُولِی الْأَلْبَابِ» (سوره آل عمران؛ آیه 190)
আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।
এই আয়াতগুলি আমাদের সাধারণ বা দৈনন্দিন দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নিয়ে যায়, এবং দেখায় যে একটি বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে—একতা থেকে বিচ্ছেদ, অগোছালো থেকে সাজানো, এবং আল্লাহর পরিকল্পনার মাধ্যমে জীবনে পরিণত।
সারসংক্ষেপ
সূরা আম্বিয়ার ৩০ নম্বর আয়াত আমাদের শুধু অতীত জানায় না; এটি আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের জন্য মানচিত্র। পৃথিবী ও আকাশ একদিন একত্র ছিল এবং আল্লাহর আদেশে আলাদা হয়েছিল। ঠিক তেমনি, মানুষও অজ্ঞতা ও অবহেলার আবরণ থেকে আলাদা হয়ে আস্থা, জ্ঞান ও ঈমান অর্জন করবে।
যেখানে বিজ্ঞান ‘কীভাবে’ দেখায়, কোরআন ‘কেন’ দেখায়। এই ‘কেন’-এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় জীবনের অর্থ, মানুষের দায়িত্ব এবং স্রষ্টার অশেষ শক্তি ও জ্ঞান।
সূত্র: কুরআন কারিম, তাফসীর আল-মীজান খন্ড,৩।



