শিশুদের ধৈর্য ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখানোর গুরুত্ব ও পদ্ধতি
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: শৈশবের সূচনালগ্নে ধৈর্য ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এই গুণাবলি ভবিষ্যতের সামাজিক অভিযোজন, শিক্ষাগত সাফল্য এবং মানসিক সুস্থতার ভিত্তি রচনা করে। আজকের দ্রুতগামী পৃথিবীতে শিশুরা নানা রকম উদ্দীপনার মুখোমুখি হয়—ডিজিটাল খেলনা থেকে শুরু করে সামাজিক প্রত্যাশা পর্যন্ত—যা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও ধৈর্যচর্চাকে কঠিন করে তোলে। এই বয়সে শিশুর মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলো (যেমন: প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স) এখনো বিকাশমান। তাই তারা মূলত অভিভাবক ও পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখে। গবেষণা বলছে, লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ শিশুদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দমন ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ধৈর্য ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ কেন জরুরি?
দুই থেকে ছয় বছর বয়সের শিশুদের প্রতিদিনই নানা চাহিদা, খেলা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়। খেলায় পালা নেওয়া, খেলনা রেখে খাওয়ায় বসা কিংবা বিদ্যালয়ের নিয়ম মানা—সবই ধৈর্য ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দমন করার ক্ষমতা দাবি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলায় এই দক্ষতা অর্জন করে, তারা বড় হয়ে আত্মবিশ্বাসী, সামাজিকভাবে সুসংগত এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সফল হয়।
ওয়াল্টার মিশেলের বিখ্যাত “মার্শম্যালো পরীক্ষা” প্রমাণ করে, যারা অপেক্ষা করতে পারে, তারা ভবিষ্যতে আরও সফল হয়। এই ধৈর্য শিশুকে ব্যর্থতা, রাগ বা উদ্বেগের সময়ে সংযত থাকতে সাহায্য করে।
শিশুর মনে কী ঘটে?
ধরা যাক, আপনি শিশুকে নিয়ে রুটির দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন। সে যতক্ষণ এগিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ খুশি; কিন্তু বিক্রেতা দেরি করলেই সে অস্থির হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে তার আবেগপ্রবণ মস্তিষ্ক (যেমন: অ্যামিগডালা) যুক্তিবাদী অংশকে ছাপিয়ে যায়। সে এখনো শেখেনি কীভাবে থেমে গিয়ে গভীর শ্বাস নিতে হয়। তাই তার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক।
তাত্ত্বিক ভিত্তি
পিয়াজে বলেন, এই বয়সে শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক ও যুক্তির সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকে। তারা অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারে না, ফলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়।
বাউলবি ও এইন্সওয়ার্থ-এর মতে, নিরাপদ সংযুক্তি আবেগ নিয়ন্ত্রণ শেখার ভিত্তি। সংবেদনশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল অভিভাবক শিশুর মধ্যে নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলেন, যা আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তি।
জাইমেনস্কি ও মার্শাল-এর আবেগ নিয়ন্ত্রণ মডেল তিনটি ধাপে গঠিত:
১.আবেগ শনাক্তকরণ: “আমি রাগান্বিত” বা “আমি দুঃখিত” বলা শেখা।
২.প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া দমন: সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া না দিয়ে থেমে যাওয়া।
৩.বিকল্প আচরণ প্রয়োগ: গভীর শ্বাস, সাহায্য চাওয়া বা কথা বলা।
এই ধাপগুলো ধীরে ধীরে অভ্যাস, অনুকরণ ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুর মনে গেঁথে যায় এবং ভবিষ্যতের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি স্থাপন করে। 
ধাপে ধাপে শিশুর অন্তর্গত ধৈর্য গড়ে তোলা
১. আচরণে আদর্শ স্থাপন – অভিভাবকের মডেলিং শিশুরা বড়দের আচরণ দেখে শেখে। যদি আপনি চাপের মুহূর্তে শান্ত থাকেন, ধৈর্য ধরেন, তাহলে শিশুও সেই আচরণ অনুকরণ করবে। যেমন, যানজটে রাগ না করে গভীর শ্বাস নিয়ে বলুন, “প্রতীক্ষা জীবনেরই অংশ।” গবেষণা বলছে, অভিভাবকের ইতিবাচক আচরণ শিশুদের আত্মনিয়ন্ত্রণে গভীর প্রভাব ফেলে।
২. আবেগের নামকরণ ও সংলাপ শিশুরা প্রায়ই বুঝতে পারে না তারা ঠিক কী অনুভব করছে। তাকে সাহায্য করুন অনুভূতিগুলো চিহ্নিত করতে—“তুমি কি এখন রাগান্বিত?” এই নামকরণ তাকে নিজের আবেগ বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। Emotion Review-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, আবেগের ভাষা শেখা শিশুর প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
৩. ধৈর্যচর্চার খেলা যেসব খেলায় পালা নেওয়া বা অপেক্ষা করতে হয়, তা ধৈর্য শেখাতে কার্যকর। যেমন: লুডু, দাবা, কিংবা কেক বানানোর মতো অপেক্ষার কাজ। “লাল বাতি–সবুজ বাতি” বা “মিউজিক থেমে গেলে স্থির থাকা”—এই খেলাগুলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দমন করতে শেখায়।
৪. সচেতন শ্বাস ও ধৈর্যচর্চা মাইন্ডফুলনেস বা সচেতনতা চর্চা শিশুকে আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাকে শেখান রাগ বা অস্থিরতার সময় গভীর শ্বাস নিতে বা শরীরের অনুভূতিতে মনোযোগ দিতে। “বেলুনের মতো শ্বাস”—যেখানে সে কল্পনা করে তার পেট ফুলছে ও চুপচাপ হচ্ছে—এই খেলাটি মজাদার ও কার্যকর।
৫. সমস্যা সমাধানে উৎসাহ প্রতিটি উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনার পর জিজ্ঞেস করুন, “পরেরবার তুমি কী করতে পারো?” এই সহজ প্রশ্ন তার চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনার ক্ষমতা বাড়ায়।
৬. ধৈর্যের জন্য পুরস্কার শিশুকে এমন পরিস্থিতিতে রাখুন, যেখানে সে অপেক্ষা করে পুরস্কার পায়। যেমন, “যদি রাতের খাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করো, তাহলে মিষ্টি পাবে।” এই অভ্যাস তাকে দীর্ঘমেয়াদি পুরস্কারের ধারণা শেখায় এবং তাৎক্ষণিক চাহিদা দমন করতে সাহায্য করে।
মনে রাখার মতো কিছু কথা
১.শাস্তি নয়, সহানুভূতি দিন: আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য শাস্তি নয়, বরং সহানুভূতিশীল দিকনির্দেশনা দিন।
২.বয়স অনুযায়ী প্রত্যাশা রাখুন: তিন বছরের নিচে শিশুরা আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বল—তাদের সীমাবদ্ধতা বুঝে আচরণ করুন।
৩.শান্ত পরিবেশ গড়ে তুলুন: অতিরিক্ত শব্দ, স্ক্রিন টাইম কমিয়ে শিশুর মনোযোগ ও স্থিরতা বাড়ান।
এই


ধাপগুলো শিশুর অন্তর্গত শক্তিকে জাগ্রত করে, তাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তোলে—যেখানে ধৈর্য, সংযম ও সহানুভূতি তার পথচলার সঙ্গী হবে।



