আধুনিকতার উত্থানে শালীনতা-বিমুখতার গঠনগত প্রতিফলন
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির : ডিজিটাল যুগে হায়া বা লজ্জাশীলতা মানে হলো আত্মনিয়ন্ত্রণের জ্ঞানী চর্চা— সেই সাহস, যা অসংযত দৃষ্টির ভিড়ে “না” বলতে শেখায়। যদি গণমাধ্যমের যুক্তিতে “দেখা যাওয়া” মূল্যবোধ হয়, তবে বিশ্বাসের যুক্তিতে “অদৃশ্য থাকা, কেবল আল্লাহর জন্য”— সেটিই সর্বোচ্চ মর্যাদা। আজকের দ্রুতবেগী দুনিয়ায়, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যক্তিগত ও সামাজিক সীমানাকে বিলুপ্ত করেছে, সেখানে এক শব্দ—যা একদিন নৈতিকতার স্তম্ভ ছিল—এখন যেন অপরিচিত, এমনকি পশ্চাৎমুখী বলে মনে হয়: “লজ্জা”।
লজ্জা: ঈমানের পরিচায়ক
ইসলামী দৃষ্টিতে হায়া ঈমানের নিদর্শন, আল্লাহর উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতার প্রতীক। আমিরুল মুমিনিন ইমাম আলী (আ.) বলেন:
«لا إِيمَانَ كَالْحَيَاءِ وَالصَّبْرِ»
“লজ্জা ও ধৈর্যের মতো কোনো ঈমান নেই।”
(নাহজুল বালাগা হিকমাত ৪১০)
কিন্তু আধুনিক সমাজে মানুষ নিজেকে আর আল্লাহর সঙ্গে নয়, বরং অন্যের দৃষ্টি ও নিজের আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার তাঁর ‘Protestant Ethics and the Spirit of Capitalism’ গ্রন্থে এই পরিবর্তনকে বলেন— “দুনিয়াবি প্রেরণার যুগ”; যেখানে আচরণের মূল্য নৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং সামাজিক কার্যকারিতা ও আর্থিক লাভে নির্ধারিত হয়।
বেহায়াপনা: নৈতিক বিচ্যুতি নয়, বাজারের যুক্তি
এই কাঠামোয় “বেহায়াপনা” আর নৈতিক অপরাধ নয়, বরং মিডিয়া ও বাজারের অংশ। জ্যাঁ বোদ্রিয়ার তাঁর ‘The Consumer Society’ বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে শরীর, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগ পুঁজিবাদের উৎপাদনযন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
অতএব, যা একসময়ে নৈতিকভাবে “নিষিদ্ধ” ছিল, আজ অর্থনীতির ভাষায় তা “প্রস্তাবিত”।
লজ্জাহীনতার কাঠামো
এই প্রবণতার স্বাভাবিক ফল হলো গোপনতার পতন। সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি গিডেনস তাঁর ‘Modernity and Self-Identity’ গ্রন্থে বলেন— আধুনিক সমাজে মানুষ ক্রমাগত দৃশ্যমান, তার পরিচয় গঠিত হয় অন্যদের চোখে। এই অবিরাম “দেখা যাওয়া” এক ধরনের “গঠনমূলক বেহায়াপনা” তৈরি করে— যেখানে মানুষ আল্লাহর ভয়ে নয়, বরং ভার্চুয়াল দৃষ্টিপাতের বিচারে লজ্জিত বা গর্বিত হয়।
হায়া: মর্যাদার রক্ষাকবচ
এর বিপরীতে ইসলাম শেখায়— লজ্জা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং মানব মর্যাদার প্রহরী। ইমাম সাদিক (আ.) বলেন:
«الْحَيَاءُ مِنَ الإِيمَانِ وَالإِيمَانُ فِي الْجَنَّةِ»
“লজ্জা হলো ঈমানের অঙ্গ, আর ঈমান জান্নাতে নিয়ে যায়।”
(আল কাফি, খন্ড ২ পূষ্টা ১০৬,)
এই অর্থে হায়া মানে আত্মরক্ষা, আত্মদমন নয়। এটি এমন এক চেতনা যা মানুষকে নিজের মর্যাদা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ডিজিটাল যুগে লজ্জার নতুন সংজ্ঞা
আজকের সমাজে হায়ার পুনঃসংজ্ঞা প্রয়োজন। ডিজিটাল যুগে লজ্জা মানে হলো— নিজের সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা, অসংযত দৃষ্টির সামনে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা।
যদি মিডিয়ার যুক্তি হয় “দেখা যাওয়া মানেই মূল্য,” তবে ঈমানের যুক্তি হলো— “দেখা না যাওয়া, যদি তা আল্লাহর জন্য হয়, সেটিই শ্রেষ্ঠ সম্মান।”
আল্লাহর উপস্থিতি: সর্বোচ্চ সচেতনতা
আধুনিক সমাজে হায়া পুনর্জাগরণ মানে হলো— আল্লাহকে মানুষের দৃষ্টিসীমায় ফিরিয়ে আনা, স্মরণ করানো যে, ভার্চুয়াল বিশ্বের আগে এক বাস্তব নিগরান আছেন, যিনি সব দেখেন:
«أَلَمْ يَعْلَمْ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى»
“সে কি জানে না, আল্লাহ তো সবই দেখছেন?
(সূরা আলাক,আয়াত ,১৪)
যদি এই সত্য নতুন প্রজন্মের চেতনায় জীবিত হয়, তবে তা আত্মমগ্নতা, আত্মপ্রেম ও সামাজিক উদ্বেগের বহু সংকট নিরাময় করতে পারে। হায়া কোনো স্বাধীনতার শত্রু নয়; বরং এটি মানুষের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার রক্ষাকবচ— অন্যের দৃষ্টির বন্দিত্ব থেকে মুক্তির প্রতীক।
এই দুনিয়ায়, যেখানে “সবকিছু দেখা চাই”, সেখানে হায়া হলো “না-দেখা” ও “দেখা না যাওয়ার” সাহস। এমন সাহসই ঈমানের সূচনা।



