বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একাধিক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব কেন অসম্ভব?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: বিশ্বজগতের প্রতিটি সূক্ষ্ণতম নিয়ম, প্রতিটি সুষম সমন্বয়, প্রতিটি গতিপথ একটি কণ্ঠেই ঘোষণা দেয়—এই বিশাল সৃষ্টি বহুকেন্দ্রিক নয়; পরিচালক এক। অসীম ক্ষমতা, অপরিবর্তনীয় নিয়ম এবং নিখুঁত শৃঙ্খলার এই মহাবিশ্ব প্রমাণ করে: একাধিক সৃষ্টিকর্তার ধারণা অন্তঃসারশূন্য, আকলবিরোধী এবং বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আকল, বিজ্ঞান, কুরআন এবং ইমাম জাফর সাদিক (আ.)–এর দর্শন একত্রে প্রমাণ করে—আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়।
একাধিক আল্লাহ থাকা কেন অসম্ভব?
আকল এবং ওহীর সরাসরি বিরোধ
যেখানে সীমাবদ্ধতা নেই, সেখানে সংখ্যা কল্পনা করা যায় না।
আল্লাহর অস্তিত্ব এমন— যে কোনো স্থান, কোনো সময়, কোনো অবস্থা তাঁর মালিকানা থেকে খালি নয়। সুতরাং প্রশ্নই আসে না—আরেকজন আল্লাহ কোথায় থাকবে? একটি উদাহরণ—(শুধু বোঝার সুবিধার জন্য, তুলনা নয়) যদি একটি ঘর ১২ মিটার লম্বা কার্পেটে সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে, একই জায়গায় দ্বিতীয় একটি সম্পূর্ণ কার্পেট বিছানো সম্ভব নয়—যাতে দুটোই পূর্ণভাবে দৃশ্যমান থাকে।
এভাবে সমগ্র অস্তিত্বই ইতিমধ্যে আল্লাহর অধীন—এখানে অন্য কোনো আল্লাহর জন্য কোনো “ফাঁকা জায়গা” নেই।
একাধিক সৃষ্টিকর্তার ধারণা ঠিক ততটাই অসম্ভব,যতটা অসম্ভব—একসঙ্গে দুটি বিপরীত সত্য সত্য হওয়া।
১। আল্লাহ অসীম
অসীমের কোনো সীমা নেই। তাই তাঁর বাইরে আরেকটি “অধিকারক্ষেত্র” নির্ধারণ করা আত্মবিরোধী।
২। আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ পরিপূর্ণতা (کمال مطلق)
যেখানে পরিপূর্ণতা আছে, সেখানে অংশীদারিত্বের স্থান নেই।
কুরআন ঘোষণা করে—
«هُوَ الْواحِدُ الْقَهَّار»
তিনি এক, সর্বশক্তিমান ও সর্বময় কর্তা।” (সুরা রা’দ, ১৬)
যদি একাধিক সৃষ্টিকর্তা থাকত, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যেত
কুরআন তাকিদ দিয়ে বলে—
«لَوْ كانَ فیهِما آلِهَةٌ إِلاَّ اللَّهُ لَفَسَدَتا»
আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ/ সৃষ্টিকর্তা থাকলে—বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেত।” (সুরা আম্বিয়া, ২২)
বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়—
১.সব কক্ষপথ সুনির্দিষ্ট,
২.দিন-রাত নির্দিষ্ট নিয়মে আসে,
৩.সূর্য-চন্দ্রের প্রতিটি চালনা নির্ভুল।
একীকৃত নিয়ম মানে—একক নিয়ন্ত্রণকারী।
বিশ্বে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই—কারণ পরিচালক একজন
«ما تَری فی خَلْقِ الرَّحْمنِ مِنْ تَفاوُتٍ …»
রহমানের সৃষ্টিতে তুমি কোনো ত্রুটি পাবে না।(সুরা মুলক, ৩)
যদি দুই সৃষ্টিকর্তা থাকতেন—
| সম্ভাবনা | ফলাফল |
| ভিন্ন ইচ্ছা | সংঘর্ষ, ধ্বংস |
| এক ইচ্ছা | তাহলে তারা দুইজন নয়, এক |
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)–এর ভাষ্যে আল্লাহর একত্ব (তাওহীদ) প্রমাণের বহুবিধ যুক্তি
আল্লাহ তায়ালার একত্বের জন্য বহু যুক্তি বিদ্যমান। সুন্দর সমাপ্তির জন্য এখানে ইমাম সাদিক (আ.)–এর একটি বিশদ ও যুক্তিশীল বক্তব্য তুলে ধরা হলো। এই বর্ণনায় তিনি একত্বের বিভিন্ন যুক্তি—বিশেষত “برهان تمانع” (দুই ইচ্ছার সংঘর্ষের যুক্তি) এবং “برهان فرجه” বা “ما به الامتیاز” (দুটি সত্তা আলাদা হলে অবশ্যই তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘ফাঁক’ বা পার্থক্য থাকবে—এই যুক্তি) ব্যাখ্যা করেছেন।
হিশাম ইবনে হাকাম বর্ণনা করেন: এক ব্যক্তি, যে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করত না এবং বহু আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষপাতী ছিল, সে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)–এর কাছে প্রশ্ন তোলে। ইমাম (আ.) তাকে বললেন:
তুমি বলছো সৃষ্টিকর্তা দুইজন। তাহলে বিষয়টি তিন অবস্থার বাইরে নয়:
১. দুজনই অনাদি, চিরন্তন এবং সর্বশক্তিমান,
২. দুজনই দুর্বল ও অক্ষম,
৩. একজন শক্তিশালী, অন্যজন দুর্বল।
যদি দুজনই শক্তিশালী হয়, তাহলে কেন একজন অন্যজনকে সরিয়ে দিয়ে এককভাবে পৃথিবী পরিচালনা করে না? যদি সত্যিই তারা সর্বশক্তিমান হতো, তাহলে প্রত্যেকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র অধিকার চাইতো। কিন্তু যেহেতু আমরা বিশ্বজগৎকে সুশৃঙ্খল ও একীভূত ব্যবস্থায় পরিচালিত হতে দেখি, এটি প্রমাণ করে পরিচালক (مدبّر) একজনই।
আর যদি তুমি বলো একজন শক্তিশালী, অন্যজন দুর্বল, তাহলে দ্বিতীয়জনের দুর্বলতাই প্রমাণ করে—সে আল্লাহ নয়। এবং এইভাবে তুমি নিজেই এক আল্লাহকে স্বীকার করলে।
আর যদি তুমি বলো দু’জন আল্লাহ আছেন,তাহলে দুটি সম্ভাবনা আছে—
হয় তারা সব বিষয়ে একই, নয়তো সব বিষয়ে ভিন্ন।
কিন্তু আমরা দেখি—
১.সৃষ্টি ব্যবস্থা এক ও সুনির্দিষ্ট,
২.নক্ষত্রসমূহ নির্ধারিত কক্ষপথে চলছে,
৩.রাত ও দিন নিয়মিতভাবে পালা বদল করছে,
৪.সূর্য ও চাঁদ প্রত্যেকে নিজস্ব বিধান অনুযায়ী চলছে।
এত সুষম ব্যবস্থা প্রমাণ করে—পরিচালক একজনই। এছাড়াও, তুমি যখন দাবি করো আল্লাহ দুইজন, তাহলে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটি পার্থক্য থাকতে হবে, যাতে তাদের দুইজন বলা যায়। আর সেই পার্থক্যও যদি অনাদি হয়,তাহলে তৃতীয় একটি সত্তা যুক্ত হয়ে যায়। যদি তুমি তিনজন আল্লাহ বলো,তাহলে তিনজনের মাঝে দুটি পার্থক্য থাকার কথা, ফলে সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় পাঁচে। এইভাবে সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত অসীম হয়ে যাবে।
মূল আরবি হাদিস
لَا یَخْلُو قَوْلُکَ إِنَّهُمَا اثْنَانِ مِنْ أَنْ یَکُونَا قَدِیمَیْنِ قَوِیَّیْنِ أَوْ یَکُونَا ضَعِیفَیْنِ أَوْ یَکُونَ أَحَدُهُمَا قَوِیّاً وَ الْآخَرُ ضَعِیفاً فَإِنْ کَانَا قَوِیَّیْنِ فَلِمَ لَا یَدْفَعُ کُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا صَاحِبَهُ وَ یَتَفَرَّدُ بِالتَّدْبِیرِ وَ إِنْ زَعَمْتَ أَنَّ أَحَدَهُمَا قَوِیٌّ وَ الْآخَرَ ضَعِیفٌ ثَبَتَ أَنَّهُ وَاحِدٌ کَمَا نَقُولُ لِلْعَجْزِ الظَّاهِرِ فِی الثَّانِی… فَیَکُونَ خَمْساً ثُمَّ یَتَنَاهَی فِی الْعَدَدِ إِلَی مَا لَا نِهَایَةَ فِی الْکَثْرَة
তওহীদের বুদ্ধিবৃত্তিক দীপ্তি: বহু সৃষ্টিকর্তার ধারণার যৌক্তিক পর্যালোচনা
বিশ্বজগতের বিস্তৃত পরিসরে যে সুশৃঙ্খলতা, সামঞ্জস্য ও একক নীতির ছাপ প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হয়, তা যেন এক মহাজ্ঞানী সত্তার নিখুঁত পরিকল্পনার সাক্ষ্য। প্রতিটি নক্ষত্র, প্রতিটি কণার গতি, প্রতিটি জীবের জৈবিক বিন্যাস—সবকিছুই যেন একক ইচ্ছা ও প্রজ্ঞার ছায়ায় পরিচালিত। এই সুবিন্যস্ত সৃষ্টির মাঝে বহু আল্লাহর অস্তিত্ব কল্পনা করা, যেন সেই শৃঙ্খলার বুকে বিশৃঙ্খলার বীজ রোপণ।
ধরা যাক, দুটি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান সত্তা বিদ্যমান। তবে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব প্রজ্ঞা ও ইচ্ছা অনুসারে সৃষ্টিতে ও পথপ্রদর্শনে প্রভাব বিস্তার করার কথা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা—সৃষ্টিতে একটিই নীতি, একটিই ইচ্ছা, একটিই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা। নবীদের আহ্বানও একক আল্লাহর দিকে, বহুত্বের দিকে নয়।
যদি বহু আল্লাহ থাকতেন, তবে তাদের প্রজ্ঞার বহুমাত্রিক প্রকাশে জগতের রূপও হতো বিচিত্র ও বিপর্যস্ত। কিন্তু আমরা দেখি, এক অভিন্ন ছন্দে বিশ্বজগতের প্রতিটি অনু-পরমাণু নৃত্য করে। এই একত্বই প্রমাণ করে—বহু আল্লাহর সম্ভাবনা বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আর যদি বলা হয়, বহু আল্লাহ একক প্রজ্ঞার অনুসরণ করছেন, তবে প্রশ্ন জাগে—কেন একজন পরিপূর্ণ সত্তা অন্যের সিদ্ধান্তের অধীন হবেন? পরিপূর্ণতা কখনোই পরাধীনতার ছায়ায় দাঁড়ায় না। এটি তাওহীদত্বের মৌলিক স্বরূপের পরিপন্থী।
তৃতীয় সম্ভাবনায়, যদি বাকিরা একজন আল্লাহর প্রজ্ঞার অনুসরণ করেন, তবে তাদের অস্তিত্বই হয়ে পড়ে অপ্রয়োজনীয়। কার্যকারিতা ও কর্তৃত্বের অভাবে তারা হয়ে ওঠেন নিছক ছায়া—যাদের উপস্থিতি অর্থহীন। অতএব, যুক্তি ও বাস্তবতার আলোকে ঈশ্বর একক, অদ্বিতীয়, এবং পরিপূর্ণ।
পাদটীকা:
১. সূরা র‘দ, আয়াত ১৬।
২. সূরা আনবীয়া, আয়াত ২২।
৩. আত-তাওহীদ (লিল-সদূক), ইবন বাবাওয়ে, মুহাম্মদ ইবন আলী; গবেষক/সম্পাদক: হাসেম হোসেইনি; জাম‘আতে মাদারেসিন, ইরান, কোম; ১৩৯৮ হিজরি ক্বোমি, প্রথম সংস্করণ, পৃ. ২৫০।
৪. সূরা মুলক, আয়াত ৩।
৫. আত-তাওহীদ, পূর্বের, পৃ. ২৪৩-২৪৪।
উৎস: পাসুখে -শুবহাতে কালামী ,আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজী।



