আজকের দিনটিকে উপভোগ কর, কিন্তু আগামী দিনের জন্যও নিজেকে প্রস্তুত রেখো
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: এই লেখাটি মানুষের জীবন, তার সীমাবদ্ধতা, এবং মৃত্যুর অবধারিত সত্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে—ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মোহ ছেড়ে চিরস্থায়ী জীবনের প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)–এর গভীর ও কালজয়ী উপদেশের আলোকে, লেখাটি আমাদের সময় ব্যবস্থাপনা, অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও নৈতিক জীবনযাত্রার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে আহ্বান জানায়।
এই দুনিয়া গন্তব্য নয়—এ কেবল এক পথচলার মায়াময় বিরতি, যেখানে কিছুই স্থায়ী নয়। যৌবন, স্বাস্থ্য, ধন-সম্পদ, খ্যাতি—সবই সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়। ক্ষণস্থায়ী বিষয়গুলোর প্রতি অতিরিক্ত মোহ আমাদের মূল উদ্দেশ্য—অন্তহীন পরিণতির প্রস্তুতি—থেকে বিমুখ করে। যখন মানুষ মৃত্যুর পর হারিয়ে যাবে এমন সম্পদের জন্য জীবন ব্যয় করে, তখন সে আসলে বিপথে হাঁটে। এই ক্ষণিকের মোহ আত্মার শক্তি ক্ষয় করে, আর শেষে হাতে থাকে কেবল অনুশোচনা।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদনের সময় সীমাবদ্ধ—প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি অবসর, প্রতিটি সুস্থতার মুহূর্তই হলো সঞ্চয় করার সুযোগ। “উপযুক্ত সময়” এর অপেক্ষা এক ভ্রম; আসল সময় তো এই মুহূর্তই। নেক আমল, আত্মশুদ্ধি ও চরিত্রের উন্নতির প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের অনন্ত জীবনের পাথেয়। এখনই আমাদের চিরস্থায়ী আবাসের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে।
কালের আবর্তে আমরা নিজেদের নিমজ্জিত করেছি অর্থহীন প্রতিযোগিতায়—খ্যাতি, সম্পদ ও ক্ষণিক সুখের পিছনে দৌড়ে। অথচ জানি এগুলোর পরিণতি নেই। “নশ্বর”-কে “অবিনশ্বর”-এর উপর প্রাধান্য দেওয়াই আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি।
মানুষের মনোভাব বদলে দিতে সবচেয়ে তীব্র বাস্তবতা হলো—মৃত্যু। মৃত্যু কোনো সম্ভাবনা নয়; এক নিশ্চিত সত্য, যার সময় আমাদের অজ্ঞাত। এই সত্য দুনিয়াবি সব পরিকল্পনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। যদি জানা থাকত আগামিকাল আমরা নেই, তবে তুচ্ছ কাজে ডুবে থাকার সাহসই বা কোথায় পেতাম?
সংসারের কোলাহল ও সংবাদমালার ভিড়ে হঠাৎই যুগ যুগান্তরের গভীরতা থেকে এক তীক্ষ্ণ ধ্বনি শোনা যায়—যা নীরবতার প্রাচীর ভেঙে সত্যকে স্মরণ করায়। সেটি আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)–এর প্রজ্ঞাময় বাণী—যা কালকে অতিক্রম করে প্রতিদিন নতুন করে দীপ্ত হয়। তাঁর আহ্বান আমাদের অস্তিত্বের অর্থ ও চলার পথ নিয়ে আত্মচিন্তায় নিমজ্জিত করে। তিনি বলেন:
قَدْ عَلِمَ السَّرَائِرَ وَ خَبَرَ الضَّمَائِرَ، لَهُ الْإِحَاطَةُ بِکُلِّ شَیْءٍ وَ الْغَلَبَةُ لِکُلِّ شَیْءٍ وَ الْقُوَّةُ عَلَى کُلِّ شَیْءٍ؛ فَلْیَعْمَلِ الْعَامِلُ مِنْکُمْ فِی أَیَّامِ مَهَلِهِ قَبْلَ إِرْهَاقِ أَجَلِهِ، وَ فِی فَرَاغِهِ قَبْلَ أَوَانِ شُغُلِهِ؛ وَ فِی مُتَنَفَّسِهِ قَبْلَ أَنْ یُؤْخَذَ بِکَظَمِهِ؛ وَ لْیُمَهِّدْ لِنَفْسِهِ وَ قَدَمِهِ؛ وَ لْیَتَزَوَّدْ مِنْ دَارِ ظَعْنِهِ لِدَارِ إِقَامَتِهِ
এই বাণীর মর্ম হলো—দুনিয়া “দার-ই-যাআন” (অস্থায়ী ভ্রমণশালা)। আমরা এখানে পথিক, আর সব নির্মাণই সময়ের কাছে নত। ক্ষণস্থায়ী জগতের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগই সবচেয়ে বড় বিভ্রম, যা মানুষকে সত্যের পথ থেকে অন্ধ করে দেয়।
এ বাণীর হৃদয়বিন্দু হলো সময়ের মূল্যায়ন। আলী (আ.) বলেন—“অবকাশের দিনগুলো” কর্মের জন্য; মৃত্যুর পর আর ফিরে পাওয়া যায় না। সুযোগ নষ্ট করার চেয়ে বড় ক্ষতি নেই।
যৌবন, সুস্থতা ও অবসর—এগুলো সহজ সময়; এগুলো নষ্ট করলে কর্মের কঠিন সময় আমাদের অসহায় করে। আর “নিজের জন্য ভূমি প্রস্তুত করা”—এ বলতে বোঝায় চরিত্র গঠন, নৈতিক দৃঢ়তা এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা—যা চিরস্থায়ী পথচলাকে নিরাপদ করে।
পরিণতির আবাস—“দার-ই-ইকামাহ”—হলো সেই চিরন্তন ঘর; যার পাথেয় হলো ঈমান, চরিত্র ও নেক আমল। দুনিয়ায় বাস স্থায়ী নয়, কিন্তু এখানেই অনন্ত জীবনের জন্য পুঁজি জমা হয়।
এই বাণী শুধু নসিহত নয়—বরং আধ্যাত্মিক জীবনের এক সুস্পষ্ট কর্মপন্থা। ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি শ্বাসকে ব্যবহার করতে হবে অনন্তের প্রস্তুতির জন্য।



