জয়ের মুহূর্তেও বিনয়: ঈমানদারের হৃদয়ে একমাত্র শক্তির উৎস আল্লাহ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির:একজন প্রকৃত ঈমানদার জানেন, বিজয় কিংবা আনন্দের মুহূর্তেও অহংকার নয়, বরং বিনয়ই তাঁর অলংকার। কারণ, এই বিশ্বজগতে একমাত্র যে শক্তি ও ইচ্ছা কার্যকর, তা হলো আল্লাহর। তাই তিনি জানেন, প্রতিটি সাফল্য, প্রতিটি সৌন্দর্য, প্রতিটি রক্ষা—সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। এমন বিশ্বাসই ঈমানদারকে অহংকার থেকে রক্ষা করে এবং তাকে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় রাখে।
ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তাঁর বিখ্যাত দোয়া সংকলন সাহিফা সাজ্জাদিয়া-তে আল্লাহর দরবারে এইভাবে নিবেদন করেন:
وَ کَمْ مِنْ بَاغٍ بَغَانِی بِمَکَایِدِهِ وَ نَصَبَ لِی شَرَکَ مَصَایِدِهِ وَ وَکَّلَ بِی تَفَقُّدَ رِعَایَتِهِ، وَ أَضْبَأَ إِلَیَّ إِضْبَاءَ السَّبُعِ لِطَرِیدَتِهِ انْتِظَاراً لاِنْتِهَازِ الْفُرْصَةِ لِفَرِیسَتِهِ وَ هُوَ یُظْهِرُ لِی بَشَاشَةَ الْمَلَقِ وَ یَنْظُرُنِی عَلَی شِدَّةِ الْحَنَقِ … وَ قَدْ کَادَ أَنْ یَحُلَّ بِی لَوْ لاَ رَحْمَتُکَ مَا حَلَّ بِسَاحَتِهِ
হে আমার প্রভু! কত যে অত্যাচারী শত্রু, যিনি ছলনার ফাঁদে আমাকে ধরতে চেয়েছে, আমার পথের পাশে ফাঁদ পেতে রেখেছে, আমাকে নজরদারিতে রেখেছে, এমনভাবে যেন এক হিংস্র পশু তার শিকারকে ধরার জন্য অপেক্ষায় থাকে। বাহ্যিকভাবে সে হাসিমুখে, চাটুকারিতায় ভরপুর, অথচ তার দৃষ্টিতে ছিল ক্রোধের আগুন। যদি তোমার রহমত না থাকত, তবে তার পরিকল্পনা আমার জীবনে বাস্তব হয়ে যেত। — দোয়া ৪৯
এই দোয়ার ভাষ্য আমাদের শেখায়, শত্রুর ছলনা যত গভীরই হোক, আল্লাহর রহমতই প্রকৃত রক্ষাকবচ। তাই বিজয়ের মুহূর্তেও ঈমানদার জানেন, তাঁর শক্তি নয়, আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকর।
কুরআনেও এই সত্য স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَٰکِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَیْتَ إِذْ رَمَیْتَ وَلَٰکِنَّ اللَّهَ رَمَیٰ وَلِیُبْلِیَ الْمُؤْمِنِینَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا إِنَّ اللَّهَ سَمِیعٌ عَلِیمٌ
তোমরা তাদের হত্যা করোনি, বরং আল্লাহ তাদের হত্যা করেছেন। তুমি যখন তীর ছুঁড়েছিলে, আসলে আল্লাহই তা ছুঁড়েছিলেন, যাতে তিনি মুমিনদেরকে এক উত্তম পরীক্ষায় ফেলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।— সূরা আনফাল, আয়াত ১৭
এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বিজয়ও এক ধরনের পরীক্ষা—যাকে বলা হয় “বালায়ে হাসান”, অর্থাৎ সৌন্দর্যময় পরীক্ষা। বিপরীতে, দুঃখ-কষ্টের মাধ্যমে যে পরীক্ষা হয়, তা “বালায়ে সাইয়্যে”।
আল্লাহ কখনো মানুষকে কেবল বিপদ দিয়ে নয়, আনন্দ ও সৌন্দর্য দিয়েও পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিনয়, কৃতজ্ঞতা ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা।
আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে:
وَکَذَٰلِکَ جَعَلْنَا لِکُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیَاطِینَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ یُوحِی بَعْضُهُمْ إِلَیٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّکَ مَا فَعَلُوهُ
আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য শত্রু বানিয়েছি—মানুষ ও জিনের শয়তান, যারা একে অপরকে মিথ্যা, কিন্তু বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় কথা বলে ধোঁকা দেয়। যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তারা তা করত না। — সূরা আনআম, আয়াত ১১২
এই আয়াত আমাদের শেখায়, শত্রুর ছলনা যতই জটিল হোক, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না।
সারকথা হলো—এই দুনিয়া এক পরীক্ষার স্থান। আমাদের দায়িত্ব হলো—আমল করা, চেষ্টা করা, কিন্তু ফলাফল নির্ধারণ করেন আল্লাহ। সেই তীর, যা কেবল হাত থেকে ছোঁড়া হয়, তার গন্তব্য ঠিক করেন তিনিই। এই বিশ্বাসই ঈমানদারকে বিজয়ের মুহূর্তেও বিনয়ী রাখে এবং তাকে অহংকারের ফাঁদ থেকে রক্ষা করে।
পদটিকা:
১. দোয়া ৪৯, সাহিফা সাজ্জাদিয়া
২. সূরা আনফাল, আয়াত ১৭
৩. তাফসিরে নূর
৪. সূরা আনআম, আয়াত ১১২
আর



