পশ্চিমা জীবনধারার চ্যালেঞ্জ ও কুরআনভিত্তিক সমাধান
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৭ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও আধুনিকতার মোহে আচ্ছন্ন পশ্চিমা জীবনধারা আজ মানবসমাজকে অভূতপূর্ব নৈতিক ও মানসিক সংকটে ফেলেছে। যেখানে সাফল্য, লাভ ও ব্যক্তিস্বাধীনতাই জীবনের লক্ষ্য, সেখানে হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক শান্তি। কুরআন ও আহলে বায়তের (আ.) শিক্ষাগুলো এই সংকটের মুখে মানবতার সামনে এমন এক বিকল্প পথের দিশা দেয়—যেখানে জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঈমান, নৈতিকতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।
এমনটাই মত দিয়েছেন কুরআনিক গবেষক ও চিন্তাবিদ জনাব মুহসিন মীরবাকেরি জানিয়েছেন :
পশ্চিমা সভ্যতায় মানবকেন্দ্রিকতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে আল্লাহর অবস্থান প্রান্তিক হয়ে পড়েছে’
মীরবাকেরির ভাষায়, পশ্চিমা জীবনধারার মূলে রয়েছে মানবকেন্দ্রিকতা (Humanism), বস্তুবাদ (Materialism) এবং ভোগবাদ (Hedonism)। এই তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সংস্কৃতি মানুষকে নিজেরই পূজারি বানিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, “এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ নিজেকেই সব কিছুর মাপকাঠি মনে করে, এবং সে ভাবে যে ঐশী দিকনির্দেশনার আর কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ কুরআন স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে —
‘তিনি কি জানেন না যিনি সৃষ্টি করেছেন? তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা মুলক, আয়াত ১৪)
মীরবাকেরির মতে, মানুষ যখন নিজেকে সূষ্টিকর্তার বিকল্প ভাবতে শুরু করে, তখনই নৈতিকতা ভেঙে পড়ে এবং সমাজে স্বার্থই একমাত্র মূল্যবোধে পরিণত হয়।
ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও পারিবারিক বন্ধনের ভাঙন
কুরআনবিশারদ বলেন, পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্যতম বড় সংকট হলো অতিরিক্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতার নামে এমন এক সমাজ তৈরি হয়েছে যেখানে পরিবার, প্রতিবেশী ও সামাজিক দায়িত্ববোধ ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
পশ্চিমে স্বাধীনতার ধারণা অনেক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়,” তিনি বলেন, যেখানে পরিবারভিত্তিক সম্পর্ক, সন্তান পালন কিংবা সমাজসেবাকে গুরুত্বহীন মনে করা হয়।”
কুরআন এ বিষয়ে ভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে —
তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁরই ইবাদত করো এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।” (সূরা ইসরা, আয়াত ২৩)
এই আয়াত ইসলামি সমাজে পরিবারকে সামাজিক স্থিতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
নৈতিকতার অবক্ষয় ও অহংকারের বিপদ
মীরবাকেরি বলেন, পশ্চিমা জীবনধারার আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হলো নৈতিকতার অবক্ষয়।
কুরআন মানুষকে সতর্ক করেছে:
পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে চলো না। (সূরা ইসরা, আয়াত ৩৭)
ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীও একই শিক্ষা দেয়:
নম্রতাকেই শয়তানের বিরুদ্ধে তোমার ঢাল বানাও
মীরবাকেরি ব্যাখ্যা করেন, ইসলামি সমাজে বিনয়, নম্রতা ও আত্মসংযম কেবল নৈতিক গুণ নয়; এগুলো সমাজের টিকে থাকার ভিত্তি। কিন্তু পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তিগত সাফল্য, প্রতিযোগিতা ও লাভের মানসিকতা সেই ভিত্তিকে ধ্বংস করছে।
সংস্কৃতিক পার্থক্য: শালীনতা বনাম উদার স্বাধীনতা
পশ্চিমা জীবনধারায় আরেকটি বড় সংকট হলো শালীনতার অবক্ষয়।
মীরবাকেরি বলেন, ইসলাম লজ্জাবোধ, পর্দা ও নারী–পুরুষ সম্পর্কের সীমারেখাকে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন বলেছে:
বিশ্বাসী নারীদের বলো, তারা যেন দৃষ্টি সংযত রাখে এবং নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করে।” (সূরা নূর, আয়াত ৩১)
তিনি যোগ করেন, “এর বিপরীতে পশ্চিমে মুক্ত সম্পর্ক ও অশালীনতা সমাজজীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে স্বীকৃত। এর ফল হলো পরিবারব্যবস্থার দুর্বলতা, বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।”
অর্থনীতি: অপচয় ও ভোগবাদী সংস্কৃতি
অর্থনৈতিক দিক নিয়েও মীরবাকেরির মত স্পষ্ট। তিনি বলেন,
কুরআন অপচয় ও বিলাসিতাকে নিন্দা করেছে এবং তা নৈতিক অবক্ষয়ের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কুরআনের বাণী:
খাও ও পান করো, কিন্তু অপচয় করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।” (সূরা আরাফ, আয়াত ৩১)
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে এর ঠিক উল্টো — ভোগবাদই এখন একপ্রকার মূল্যবোধ। মানুষ তার ব্যবহারিক জিনিস, পোশাক, গাড়ি বা জীবনযাপনের মান দিয়েই নিজের পরিচয় নির্ধারণ করে। এর ফল, সমাজে ধনী–গরিবের বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও মানসিক অসন্তোষ।
কুরআনিক সমাধান: আধ্যাত্মিকতার পুনর্জাগরণ
মীরবাকেরি তাঁর বক্তব্যের শেষে বলেন: এই নৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলায় মুসলিম উম্মাহর একমাত্র পথ হলো কুরআন ও আহলে বায়তের শিক্ষায় ফিরে যাওয়া।
তিনি জোর দিয়ে বলেন — আমাদের এমন একটি জীবনধারা পুনর্গঠন করতে হবে, যার কেন্দ্রে থাকবে আধ্যাত্মিকতা, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ও মানবিক মর্যাদা।
শুধুমাত্র কুরআনভিত্তিক জীবনধারা পুনর্জীবনের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজ পশ্চিমা বস্তুবাদী সংস্কৃতির ঢেউয়ের মোকাবিলা করতে পারবে এবং একটি সুস্থ, ভারসাম্যপূর্ণ ও ঈমাননির্ভর সমাজ গঠন করতে সক্ষম হবে।



