হাদিসে বারো খলিফা: শিয়া ও সুন্নি উভয় মতাদর্শের নির্ভরযোগ্য সূত্রে স্বীকৃত এক সহীহ বর্ণনা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামী ইতিহাসে “বারো ইমাম” বা “বারো খলিফার হাদিস” নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মতপার্থক্য বিদ্যমান। বিশেষ করে যাদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়—এ ধরনের হাদিস আসলে ইমামিয়া শিয়াদের রচিত বা পরবর্তীতে সংযোজিত একটি বিশ্বাস। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি তাই? ইতিহাস, হাদিসের মূল গ্রন্থসমূহ, এমনকি যাদিয়া ইমামদের নিজস্ব বক্তব্য এই দাবিকে মেনে নেয় কি? বিশ্লেষণ প্রমাণ করে—বরং এর উল্টো।
যায়দিয়া মূলত শিয়া ধারারই একটি উপশাখা। তারা হযরত আলী (আ.), ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পর ইমামতকে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে আলী (আ.)-এর মধ্যে সীমানাবদ্ধ মনে করে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, যে ব্যক্তিকে তারা নিজেদের ইমাম মনে করেন—সেই যায়েদ ইবনে আলী (আ.) নিজে এবং তাঁর পুত্র ইয়াহইয়া ইবনে যায়েদ স্পষ্টতই বারো ইমামের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন।
ইমামগণের প্রতি সম্মান থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে ও তাকিয়্যার নীতির প্রভাবে ইমামগণ প্রকাশ্যে যাদিয়া আন্দোলনকে সমর্থন করেননি, তবে রাওয়ায়েত এবং ইমামদের প্রশংসাবাণী প্রমাণ করে যে জায়েদ এবং তাঁর পুত্র উভয়েই ইমামিয়া বিশ্বাসের নিকটবর্তী ছিলেন।
যায়দিয়াহ (زیدیه) সম্প্রদায় বলে থাকে যে বারো ইমামের বিষয়ে যে হাদিসগুলো প্রচলিত আছে, সেগুলো ইমামিয়া শিয়ারা নিজেরাই তৈরি করেছে। তারা কেন এ ধরনের দাবি করে?
উত্তর:যায়দিয়া হল শিয়াদের একটি উপদল, যারা ইমামতকে আলী (আ.)-এর পরে ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মাধ্যমে যথার্থ মনে করলেও এরপর ইমামতের অধিকারকে যায়েদ বিন আলী (আ.)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, যায়েদ নিজে ইমামতের প্রশ্নে ইসমাইলি শিয়া বা ইমামিয়া শিয়াদের (اثنا عشری) মতের বিরোধী কোনো বিশ্বাস পোষণ করতেন না। বরং যায়েদ ও তাঁর পুত্র ইয়াহইয়া বিন যায়েদের কাছ থেকে পাওয়া বহু বর্ণনায় দেখা যায় যে, তাঁরা উভয়েই বারো ইমামের ইমামতের ওপর বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁদের সম্পর্কে ইমামিয়া শিয়াদের ইমামরাও প্রশংসা করেছেন।
তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তাকিয়ার নীতির কারণে ইমামরা প্রকাশ্যে যায়েদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি, যদিও সেই বিদ্রোহ তাঁদের যুগেই ঘটেছিল।
সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যায়দিয়াহর মধ্যেও অন্যান্য ইসলামী ফিরকার মতো বিভিন্ন মত ও বিভক্তি সৃষ্টি হয়। তাই সব যায়দির মত এক নয়। যদিও আজকের দিনে যায়দিয়াহর বেশিরভাগ উপশাখা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে তাদের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে—তারা কারও মধ্যেই ইমামিয়া শিয়াদের মতো বারো ইমামের বিশ্বাস নেই। তাই বারো ইমাম সংক্রান্ত যে হাদিসগুলো শিয়া ও সুন্নি উভয় বইতেই বিভিন্নভাবে এসেছে, তারা সেগুলোকে স্বীকার করে না এবং কেউ কেউ দাবি করে যে এসব হাদিস ইমামিয়া শিয়ারা বানিয়েছে।
কিন্তু এই দাবির জবাবে বলা উচিত:
এই বিষয়ে হাদিসের সংখ্যা এত বেশি যে সেগুলো শুধু তৈরি করা—এমন দাবি করা একেবারেই অবাস্তব। সঠিক পদ্ধতি হলো—যারা এসব হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাঁদের দিকে তাকানো। দেখা যায় যে এগুলো শুধু শিয়া সূত্রে নয়, বরং সুন্নি সূত্রেও প্রায় “তওয়াতুর” (অর্থাৎ ব্যাপক ধারাবাহিকতার সঙ্গে) বর্ণিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, সুন্নি সূত্রে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের কাছ থেকে বর্ণিত হয়েছে:
নবী (সা.) বলেছেন: “আমার পরে বারো জন খলিফা আসবেন, যাদের সংখ্যা হবে বনি ইসরাইলের নেতাদের মতো আরেকটি সুন্নি সূত্রে জাবির ইবনে সমুরাহ বর্ণনা করেন:
“আমরা নবী করিম (সা.)-এর কাছে বসেছিলাম। তিনি বললেন, এই উম্মতের ওপর বারো জন শাসন করবেন… এবং তারা সবাই কুরাইশ গোত্র থেকে হবে।”
এই ধরনের হাদিস বিভিন্ন সুন্নি গ্রন্থে নানা ভাষ্যসহ বর্ণিত হয়েছে।
শুধু তাই নয়—
যে যায়েদ বিন আলীর প্রতি যায়দিয়াহরা নিজেকে অনুসারী বলে দাবি করে, তাঁর নিজের বর্ণিত হাদিসেও বারো ইমামের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর থেকে বর্ণিত:
হে হুসাইন! তুমি ইমাম, তোমার ভাই ইমাম এবং তুমি ইমামদের পিতা। তোমার বংশধরদের মধ্য থেকে নয়জন ইমাম হবেন, যাঁদের শেষজন হবেন মাহদি।”
আর তাঁর পুত্র ইয়াহইয়া বিন জায়েদ বর্ণনা করেন, তিনি তাঁর বাবাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন:
ইমাম সংখ্যা বারো। তাদের মধ্যে চারজন ইন্তেকাল করেছেন এবং আটজন এখনো বাকি… (এরপর তিনি নামসহ বর্ণনা করেন)।”
উপসংহার:
এই সব তথ্য প্রমাণ করে যে বারো ইমামের হাদিসগুলো শুধু ইমামিয়া শিয়াদের বানানো নয়; বরং তা সুন্নি ও যায়দি উভয় সূত্রেই নির্ভরযোগ্যভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই যায়দিয়াহদের পক্ষ থেকে এসব হাদিস অস্বীকার করা ভিত্তিহীন এবং ইতিহাস ও হাদিস বিজ্ঞানের আলোকে টেকসই নয়।
আরও পড়ার জন্য প্রস্তাবিত গ্রন্থ:
১.কামালুদ্দিন ও তামামুন নি’মাহ (অনুবাদ: মনসুর পাহলাবান)
২.ফিরকাহ ও মুতকালামি মাজহাবসমূহ – আলী রাব্বানী গোলপায়েগানি
৩.তারিখে তাশায়্যু’ – মোহাম্মদ কাজেম খাজোইয়ান
পাদটীকা
১.মাশকুর, মোহাম্মদ জাওয়াদ, মাউসু‘আতে ফিরাকুল ইসলামিয়্যাহ (ইসলামি ফিরকাসমূহের বিশ্বকোষ), বৈরুত, মজমা‘উল বুহুছিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪১৫ হিজরি, পৃষ্ঠা ২৭০।
২. হানাফি কানদূযি, ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ লিয়বিল কুরবা (আহলে বাইতের প্রতি মমত্বের উত্সসমূহ), বৈরুত, দারুল উসওয়া, ১৪১৬ হিজরি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩১৫।
৩. নিশাপুরি, মুসলিম, সহিহ মুসলিম, বৈরুত, দারুল ফিকর, মুদ্রণকাল অজ্ঞাত, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩; সুনানে আবু দাউদ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩০৯; সুনানে তিরমিযি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৪০।
৪. দ্রষ্টব্য: সাফি গলপায়েগানি, লুতফুল্লাহ, মুনতাখাবুল আসার, কোম, মোয়াসসাসায়ে সাইয়্যেদা মা‘sূমা, ১৪২১ হিজরি, পৃষ্ঠা ৪৫, ৮৩।
৫. খাজ্জাজ কোম্মি, কিফায়াতুল আসার, কোম, ইনতেশারাতে বিদার, ১৪০১ হিজরি, পৃষ্ঠা ৩০৪।
৬.একই গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৩০৫।
৭. শাইখ সাদূক, কামালুদ্দিন ও তামামুন নি‘মাহ, কোম, জামে‘আ মুদাররেসিনে হাউজায়ে ইলমিয়্যে কোম, ১৪০৫ হিজরি, পৃষ্ঠা ৬৭–৬৮।



