কথিত মার্কিন ‘নিরাপত্তা চুক্তি’ ও কাতারে ইসরায়েলি হামলা; আরবদের ঘুম ভাঙবে কী?
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে আরব দেশগুলোকে নিরাপত্তা চুক্তির আশ্বাস দিয়ে এসেছে। কিন্তু কাতারে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ওয়াশিংটনের নীরবতা দেখিয়ে দিল—এই চুক্তিগুলো কতটা কার্যকর এবং কার স্বার্থে। আরব বিশ্ব কি এখন জাগবে, নাকি আগের মতোই নির্ভরতা বজায় রাখবে?
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কাতারে ইসরায়েলের হামলাকে ‘অপছন্দনীয়’ বললেও স্পষ্ট করেছেন—এটি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল কৌশলগত অংশীদারত্ব ও মিত্রতায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ বক্তব্যই প্রমাণ করে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকলেও আরব মিত্রদের নিরাপত্তা সেই অর্থে সমান অগ্রাধিকার পায় না। প্রশ্ন হচ্ছে—মার্কিন নিরাপত্তা ছাতার নিচে থেকেও যদি সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শিকার হতে হয়, তবে আরব দেশগুলোর এই অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ কী?

নিরাপত্তা চুক্তির দ্বিচারিতা
যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ একাধিক উপসাগরীয় দেশের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সামরিক ঘাঁটি এবং অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এসব চুক্তির লক্ষ্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কিন্তু কাতারে ইসরায়েলের একতরফা হামলার পরও ওয়াশিংটনের কার্যত নীরবতা এই চুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আরব রাষ্ট্রগুলো ক্রমেই বুঝতে পারছে—এই প্রতিশ্রুতিগুলো অনেক সময় কেবল ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার।
শান্তি প্রক্রিয়ায় আঘাত
কাতারের ঘটনা কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তা—ইসরায়েল এখনো শক্তি প্রয়োগকে কূটনৈতিক সমাধানের চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়। এর ফলে যুদ্ধবিরতি আলোচনা ব্যাহত হচ্ছে, আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং শান্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আস্থা ও সংলাপ অপরিহার্য; কিন্তু এই ধরনের হামলা সেই আস্থাকে ভেঙে দিচ্ছে।
আরব বিশ্বের করণীয়
এই হামলা আরব দেশগুলোর জন্য আত্মসমালোচনার সুযোগ তৈরি করেছে।
- ঐক্যবদ্ধ কূটনীতি: আরব লীগ ও আঞ্চলিক ফোরামগুলোকে সক্রিয় করে যৌথ প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে। শুধু নিন্দা নয়, জাতিসংঘে প্রস্তাব, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ও অর্থনৈতিক চাপের কৌশল নিতে হবে।
- কৌশলগত স্বনির্ভরতা: বাহ্যিক নিরাপত্তা গ্যারান্টির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে যৌথ প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও সাইবার নিরাপত্তায় বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি।
- মার্কিন সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন: যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে আরও সুষম করতে হবে। জ্বালানি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ওয়াশিংটনের নীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে হবে।
ফিলিস্তিন ইস্যু: স্থায়ী শান্তির মূল শর্ত
মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি অসম্ভব যতক্ষণ না ফিলিস্তিন প্রশ্নের ন্যায়সঙ্গত সমাধান হয়। গাজার মানবিক সংকট, দখলদারিত্ব ও অব্যাহত বসতি সম্প্রসারণ আঞ্চলিক উত্তেজনার মূল কারণ। তাই আরব রাষ্ট্রগুলোর উচিত ফিলিস্তিন ইস্যুকে কূটনীতির কেন্দ্রে রাখা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাধ্য করা যাতে ইসরায়েল আন্তরিকভাবে শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়।
কাতারে ইসরায়েলের হামলা এক ধরনের ‘রিয়েলিটি চেক’—যা দেখিয়ে দিল মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি কতটা বাছাই করা ও রাজনৈতিকভাবে সুবিধাবাদী। আরব বিশ্বের জন্য এটি একটি জাগরণের ঘণ্টা। এখনই সময় ঐক্যবদ্ধ কূটনীতি, কৌশলগত স্বনির্ভরতা ও নীতিনিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের। নইলে এমন হামলা পুনরাবৃত্ত হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে।