সন্তানকে আমানত ভাবলে লালন-পালন সহজ হয়
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: যদি বাবা–মা অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন যে তাঁরা সন্তানের প্রকৃত মালিক নন, বরং সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত এক পবিত্র আমানত, তাহলে সন্তান প্রতিপালনের বহু জটিলতা আপনা থেকেই সহজ হয়ে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের ভেতর ধৈর্য, মানসিক প্রশান্তি ও কষ্ট সহ্য করার শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। কারণ তখন মানুষ উপলব্ধি করে—তার কোলে থাকা শিশুটি “আল্লাহর আমানত”, যাকে সম্মান, যত্ন ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে লালন করতে হবে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মহসিন আব্বাসি ওয়ালদি তাঁর এক বক্তৃতায় “আমানতদারির দৃষ্টিভঙ্গি; সন্তান প্রতিপালনে ধৈর্য ও প্রশান্তির চাবিকাঠি” শীর্ষক আলোচনায় এই গভীর বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের পূর্ণ অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো—
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
মূল প্রশ্ন ও সংশয়টি হলো—এই পৃথিবীতে, আল্লাহর দৃষ্টির সামনেই যে সব জুলুম সংঘটিত হয়, যেমন গাজায় নারী, শিশু ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে নির্মম নির্যাতন নেমে এসেছে, সেই অসহনীয় কষ্ট ও হৃদয়বিদারক শাহাদত—এসব কেন আল্লাহ প্রতিরোধ করেন না? কেন তিনি জালিমদের রুখে দেন না এবং কেন মজলুমদের উদ্ধার করেন না?
এই বিষয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা যায়।
প্রথমত, এই দুনিয়া হলো পরীক্ষা ও বিপর্যয়ের আবাস।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহ মানুষের জন্য যে পরীক্ষা ও বিপদ নির্ধারণ করেন, সেগুলোর কিছু ব্যক্তিগত এবং কিছু সামাজিক চরিত্রের।
তৃতীয়ত, কিছু কষ্ট আসে আমাদের বান্দাগির পরীক্ষায় ব্যর্থতার ফল হিসেবে। এই কষ্টগুলো মানুষকে পরিশুদ্ধ করা এবং আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আসে। এগুলো আসলে “এক পরীক্ষার পর আরেক পরীক্ষা”।
চতুর্থত, আমরা আল্লাহর অবিচল ও অপরিবর্তনীয় বিধান (সুন্নাতুল্লাহ) নিয়ে আলোচনা করেছি—যেগুলো কখনো পরিবর্তিত হয় না এবং মানুষের ইচ্ছামতো সময়ে বাস্তবায়িত হয় না; বরং শর্ত পূর্ণ হলেই তা কার্যকর হয়।
কিন্তু পঞ্চম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো ‘সবর’ (ধৈর্য)।
সূরা বাকারার ১৫৫, ১৫৬ ও ১৫৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। আল্লাহ বলেন—
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ۗ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ
এরপর বলেন—
الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
অর্থাৎ, ধৈর্যশীলরা হলো তারা, যারা বিপদে পড়লে বলে— “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চিতভাবেই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।”
এখানে একটু থেমে “إِنَّا لِلَّهِ” বাক্যটির অর্থ নিয়ে ভাবা জরুরি। এই বাক্যের সঙ্গে ধৈর্যের সম্পর্ক কী? আমরা বলেছি—আমাদের অধিকাংশ অস্থিরতা, কান্নাকাটি, অভিযোগ এবং আল্লাহর তাকদির নিয়ে অসন্তোষের মূল কারণ একটিই—মালিকানা অনুভূতির ভ্রান্ত ধারণা। আমরা মনে করি, আমরা আমাদের জীবনের মালিক, আমরা আমাদের দেহের মালিক,আমরা আমাদের সম্পদের মালিক, আমরা আমাদের সন্তানদের মালিক।
বাস্তবে আমরা “মালিকানা-ভ্রমে” ডুবে আছি। যখন আমরা মনে করি কোনো কিছুর মালিক আমরা, তখন কেউ যদি আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখানে হস্তক্ষেপ করে, আমরা ভেঙে পড়ি।
ধরুন, আপনি একটি ভিড়ভাট্টা পার্ক বা মাজারে গেলেন। বসার জন্য একটি জায়গা বেছে নিয়ে চাদর বিছালেন। যদি কেউ এসে সেই জায়গায় বসে পড়ে, আপনি বিরক্ত হন, এমনকি ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন। কেন?
কারণ আপনি মনে মনে সেই জায়গাটিকে সাময়িকভাবে—নিজের সম্পত্তি ভেবে নিয়েছিলেন। অথচ বাস্তবে সেটি আপনার নয়।
এই অনুভূতিই যখন আমরা আল্লাহর সামনে নিয়ে যাই এবং মনে করি—“এই সন্তান আমার, আমার সম্পত্তি, আমার আগে”—তখন বিপদের সময় আমাদের অন্তরে অভিযোগ জন্ম নেয়।
যদি আমরা সত্যিই বিশ্বাস করতাম যে মালিক আল্লাহ, তাহলে কেন দুঃখের সময় অন্তরে তাঁর বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠত?
যদি আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা মালিক নই এবং প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ, তাহলে বহু আকীদাগত, নৈতিক ও তাওহিদি সমস্যা আপনা থেকেই সমাধান হয়ে যায়।
আল্লাহর মালিকানার ওপর ঈমানই হলো ঈমানের কেন্দ্রবিন্দু। এই বিন্দুটিই নির্ধারণ করে—মানুষ ঈমান হারাবে, না ঈমানে আরও দৃঢ় হবে।
যখন এই বিশ্বাস হৃদয়ে প্রবেশ করে, তখন দুঃখ-কষ্টের মাঝেও এক অদ্ভুত হালকাতা ও প্রশান্তি নেমে আসে। কিন্তু মালিকানা-ভ্রম যত গভীর হয়, পরীক্ষায় ভেঙে পড়াও তত সহজ হয়। আমরা কুরআনে পড়ি—
وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ
لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَى
কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি সত্যিই এতে ঈমান এনেছি? এর পরীক্ষা হয় তখনই, যখন আমাদের প্রিয় কোনো কিছু আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। তখন আমরা কি সন্তুষ্ট থাকতে পারি? এই সত্যটি সন্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা যখন অন্যের সন্তানকে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমানত হিসেবে পাই, তখন কতটা সতর্ক থাকি! কিন্তু নিজের সন্তানের বেলায় অনেক সময় সংযম হারিয়ে ফেলি—কারণ মনে করি সে “আমাদের”।
অথচ আল্লাহ বলেন—
لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَمَن فِي الْأَرْضِ
আমি এবং আমার সন্তান—দু’জনই আল্লাহর মালিকানাধীন। সন্তানকে তিনি আমার হাতে আমানত হিসেবে দিয়েছেন।
যদি এই বিশ্বাস বাস্তব জীবনে প্রবেশ করে, তাহলে সন্তান প্রতিপালনে ধৈর্য আসবে, রাগ কমবে, সহনশীলতা বাড়বে।
কারণ তখন বাবা–মা উপলব্ধি করবেন—তাঁদের হাতে রয়েছে আল্লাহর আমানত। আসুন, আমরা সবাই এই ভ্রান্ত মালিকানা-বোধ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একে অপরের জন্য দোয়া করি। আমরা কেউই প্রকৃত মালিক নই। সবকিছুই আল্লাহর। কতই না সুন্দর হতো—যদি আমরা এই সত্যটি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারতাম।



