ধর্মহীন হলেও সৎকর্মশীল—তার পরিণতি কি কল্যাণময়?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: কখনও কখনও মানুষ অনেক সৎকর্ম করে, কিন্তু নিজেকে নবী বা ধর্মের প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত মনে করে। কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হলো, ওহী এবং হেদায়াত ছাড়া এই সৎকর্ম কতটা সত্যের পথকে আলোকিত করতে পারে? যখন কেউ অনেক সৎকর্ম করে কিন্তু নিজেকে নবী এবং ধর্ম থেকে স্বাধীন মনে করে, তখন একটি নতুন প্রশ্ন উঠে আসে যে, এই সৎকর্মের মূল এবং দিকনির্দেশ কোন ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
ভূমিকা
কখনও আমরা এমন লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করি যারা অসংখ্য সৎকর্ম করে। তারা হাসপাতাল নির্মাণ করে, বিদ্যালয় স্থাপন করে, দরিদ্রদের সাহায্য করে, কিন্তু বলে: “আমি শুধু আল্লাহকে মানি, নবী এবং আহলে বাইতকে নয়।” অথবা কেউ কেউ বলে: “আমি ধর্মকেই মানি না, শুধু মানবপ্রেম করি।” প্রশ্ন হলো: এমন ব্যক্তি কি শেষ পর্যন্ত সফলতা লাভ করবে?
প্রধান আলোচনায় প্রবেশের আগে, এটা জোর দিয়ে বলতে হবে যে, আল্লাহ রহমান এবং রহীম। তিনি কোনো সৎকর্মকে পুরস্কারহীন রাখেন না। এমনকি যদি কেউ ধর্মহীন হয়েও সৎকর্ম করে, তাহলে আল্লাহ তাকে এই দুনিয়াতেই পুরস্কার দেন, যেমন ধনসম্পদ, সুনাম, স্বাস্থ্য এবং মানসিক শান্তি দিয়ে। কিন্তু মূল বিষয় হলো, এই দুনিয়াবী পুরস্কার কি সম্পূর্ণ কাহিনী, নাকি এর চেয়ে আরও কিছু আছে?
যখন কেউ বলে “আমি শুধু আল্লাহকে মানি, কিন্তু কুরআন, নবী এবং ইমামদের মানি না”, তাহলে প্রথম প্রশ্ন হলো: আপনি কোন পথে আল্লাহর কাছে পৌঁছেছেন? কীভাবে বুঝলেন যে সৃষ্টিকর্তা এক? কীভাবে মূর্তিপূজা বা খ্রিস্টান ত্রিত্ববাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে তাওহীদে (একত্ববাদে) পৌঁছেছেন? উত্তর স্পষ্ট: বুদ্ধির মাধ্যমে। কারণ আল্লাহকে পাঁচ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না, তাই তাঁকে চেনার একমাত্র উপায় হলো বুদ্ধি (আকল)। কিন্তু সেই বুদ্ধিই যা আল্লাহর একত্বকে দেখিয়েছে, তা আরও একটি কথা বলে: মানুষের জীবনে বুদ্ধির পাশাপাশি ধর্ম এবং ওহীর প্রয়োজন আছে। কেন? কারণ বুদ্ধির কার্যক্ষেত্র সীমিত। বুদ্ধি মানুষের অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণের সীমায় কাজ করে, কিন্তু ওহীর পরিধি মানুষীয় জ্ঞানের বাইরে। কুরআন বলে: “কَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ… وَ يُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ” (সূরা বাকারা/১৫১) অর্থাৎ “যেমন আমরা তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই একজন রাসূল প্রেরণ করেছি… যাতে তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন যা তোমরা জানতে না।”
যদি ওহী না থাকত, তাহলে অনেক জ্ঞান চিরকাল অজানা থেকে যেত। মানুষ বিশ্বের শুরু এবং শেষ সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকত। জানত না কেন সৃষ্টি হয়েছে, কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় যাবে। ধর্মই এই মৌলিক প্রশ্নগুলির উত্তর দেয় এবং জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। এখন যদি কেউ একটি ক্ষেত্রে (যেমন আল্লাহর অস্তিত্ব) বুদ্ধির অনুসরণ করে, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে (যেমন নবুয়ত) বুদ্ধির হুকুম অমান্য করে, তাহলে কি এটা যুক্তিসঙ্গত? কেন বুদ্ধি/আকল এক জায়গায় বৈধ এবং অন্য জায়গায় অবৈধ?
যদি ধর্ম না থাকে, তাহলে আল্লাহর বিশ্বাসের কী লাভ? ধরুন কেউ শুধু আল্লাহর বিশ্বাস করে, কিন্তু নবী, ধর্ম, আখিরাত এবং কিয়ামতকে বিশ্বাস করে না। এই বিশ্বাস তার কোন সমস্যা সমাধান করে? যদি আখিরাতে বিশ্বাস না করে, তাহলে আল্লাহর অস্তিত্ব থাকা বা না থাকার কী পার্থক্য? মনে হয় এই ধরনের বিশ্বাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে “কাফির” বা “আল্লাহহীন” উপাধি থেকে পালানোর জন্য। এটা এক ধরনের অগ্রগমনের পলায়ন, যাতে ধর্মীয় দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু ধর্মহীনতার অভিযোগ না পড়ে। এটা সেই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস যিনি তাঁর সৃষ্টিকে নিজেদের হালে ছেড়ে দিয়েছেন, এবং এটা হেকমতময় এবং রহমান আল্লাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ইমান ছাড়া সৎকর্মের কী পরিণতি? এখন মূল প্রশ্নে ফিরে আসি: যদি কেউ হাসপাতাল নির্মাণ করে, মানুষের সেবা করে, কিন্তু আল্লাহ, নবী এবং কিয়ামতে বিশ্বাস না করে, তাহলে কী হবে? কুরআন মজীদের স্পষ্ট উত্তর আছে: “مَن كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَ زِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَ هُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ” (সূরা হুদ/১৫) “যারা দুনিয়ার জীবন এবং তার শোভা চায়, আমরা তাদের কর্মের ফল তাদেরকে এখানেই পূর্ণরূপে দিয়ে দেই এবং এতে তাদের কোনো কমতি করা হয় না।” “أُولَـٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيهَا وَبَٰطِلٞ مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ” (সূরা হুদ/১৬) “এরাই তারা যাদের জন্য আখিরাতে আগুন ছাড়া আর কিছু নেই এবং যা তারা এখানে তৈরি করেছে তা ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং যা তারা করত তা বাতিল।”
এই আয়াতগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রকাশ করে: কর্মের পুরস্কার নিয়ত এবং বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। যদি কেউ সৎকর্ম দুনিয়ার জন্য করে (খ্যাতি, মানুষের সম্মান বা সুনামের জন্য), তাহলে তার পুরস্কার এই দুনিয়াতেই পাবে। আল্লাহ যিনি সবচেয়ে দয়াময়, তাকে এই পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করেন না। সে দুনিয়াতে প্রিয় হয়ে উঠবে, তার নাম অমর হবে, হয়তো ধনী হবে। কিন্তু আখিরাতে তার কিছু নেই, কারণ তার কর্ম আল্লাহর জন্য ছিল না।
ইখলাসের ভূমিকা: দুনিয়ার জন্য কর্ম এবং আল্লাহর জন্য কর্মের মধ্যে পার্থক্য আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলী বলেন: কিয়ামত এমন এক জগত যেখানে প্রত্যেক জিনিসের সত্যতা প্রকাশিত হয়। ইসলামে, আল্লাহর জন্য কর্ম গ্রহণীয় এবং যদি কর্ম অন্যের জন্য হয়, তাহলে তার আখিরাতী ফল নেই। হুসন-ই ফিলী (কর্মের বাহ্যিক সৌন্দর্য) একা যথেষ্ট নয়। হুসন-ই ফায়িলী (কর্মকারীর নিয়ত এবং ইমান)ও প্রয়োজন। অর্থাৎ কর্ম ইখলাসের সাথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে, এবং ইখলাসের শর্ত হলো ইমান। ইখলাস অর্থাৎ আল্লাহর জন্য কর্ম। এটাই সেই চালকশক্তি যা এক্সিরের মতো কাজ করে এবং কর্মের মূল্য নির্ধারণ করে। একটি ছোট কর্ম কিন্তু ইখলাসের সাথে, এতটা মূল্যবান হয়ে ওঠে যে শুধু আল্লাহই তার পুরস্কার জানেন।



