নামহীন নারীদের আধ্যাত্মিক যাত্রা—যেখানে সাধনা হয়ে উঠেছে অমরতার পথ
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন । প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ইসলামী আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে পরিচিত কিছু মহীয়সী নারীর নাম আমাদের জানা থাকলেও, অসংখ্য নারী নীরবে ও নিভৃতে এই সাধনার ভিত্তি নির্মাণ করেছেন। সমাজের চোখের আড়ালে থেকেও তাঁরা ছিলেন তাসাউফ ও আত্মিক উৎকর্ষের মূল স্তম্ভ—মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, কিংবা বোন হিসেবে। তাঁদের জীবন ও প্রভাব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইসলামী আধ্যাত্মিকতায় নারীর ভূমিকা কখনোই গৌণ ছিল না, বরং বহু ক্ষেত্রে ছিল গভীর ও নির্ণায়ক।
ইতিহাসের নীরবতায় গড়ে ওঠা আধ্যাত্মিক নারীরা
পরিচিত নারীদের পাশাপাশি ইতিহাসের নীরবতায় অসংখ্য নারী ছিলেন, যাঁরা আধ্যাত্মিকতার প্রধান স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন। এমন মায়েরা ছিলেন, যাঁরা আত্মিক দুধে লালন করেছিলেন রাবেয়া ও বায়েজিদের মতো মহান সাধকদের; এমন স্ত্রী ছিলেন, যাঁরা দারিদ্র্যে নিমগ্ন যাহিদ স্বামীদের পাশে ধৈর্য ও ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন; আর এমন বোনও ছিলেন, যাঁরা বাসার হাফির বোনের মতো জুহদের পাঠ শিখিয়েছিলেন।
ইসলামে নারী–পুরুষের আধ্যাত্মিক সমতা
ইসলাম নারী ও পুরুষের মধ্যে ইবাদত ও আল্লাহর মারেফাত অর্জনের ক্ষেত্রে স্পষ্ট সমতার কথা ঘোষণা করেছে: পুরুষরা যা অর্জন করে, তা থেকে তাদের অংশ আছে; আর নারীরা যা অর্জন করে, তা থেকেও তাদের অংশ রয়েছে।” (সুরা নিসা, আয়াত ৩২)
এই সমতা শারীরিক পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত আত্মিক সক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে। পরিবারব্যবস্থায় নারীর নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও ভূমিকা থাকলেও, জ্ঞান ও ইবাদতের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাতে তাঁর জন্য কোনো বাধা নেই।
ইসলামের প্রথম প্রভাতে নারীর আলোকিত উপস্থিতি
হযরত খাদিজা (সা.আ.) ও হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবন থেকে শুরু করে ইসলামের সূচনালগ্নের অগ্রগামী নারীদের জীবন আমাদের সামনে এই মর্যাদার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে সমাজে কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, সেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কন্যার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে ধর্মীয় মূল্যবোধে জাগ্রত করেছিলেন। হযরত ফাতিমা (সা.আ.) পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কুরআনের তাফসির ও গভীর ঈমানি গঠনে অনন্য আদর্শ হয়ে ওঠেন।
ইতিহাসের অদৃশ্য দেয়াল
তবুও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—সামাজিক চাপ ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার কারণে বহু নারী তাঁদের আত্মিক প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পাননি। কুরআন যেখানে জ্ঞানার্জনের আহ্বান লিঙ্গভেদ ছাড়াই ঘোষণা করেছে, সেখানে বহু যুগে নারীরা ইতিহাসের অন্ধকার কোণে আড়ালেই রয়ে গেছেন।
এমনকি সুফিবাদের মতো ক্ষেত্রে, যেখানে একমাত্র মানদণ্ড “পবিত্র হৃদয়”, সেখানেও তাঁদের উপস্থিতি কম লেখা হয়েছে। কারণ সমাজ অনেক সময় আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুর বদলে তার বাহক নারী না পুরুষ—সেটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
ইসলামী তাসাউফে বৈষম্যের স্থান নেই
ইসলামী তাসাউফ অন্যান্য ধর্মীয় ক্ষেত্রের মতোই বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেয় না। বড় বড় সুফি মনীষীরা সবসময় জোর দিয়েছেন যে সত্যের পথে চলা নির্ভর করে আত্মার পবিত্রতা ও খাঁটি ইচ্ছার ওপর, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থানের ওপর নয়। ইতিহাসে যেসব নারী সুফির নাম টিকে আছে, তাঁদের জীবন এই মৌলিক সত্যেরই প্রমাণ।
রাবেয়া বসরি
রাবেয়া আদবিয়া ইসলামী আধ্যাত্মিকতার আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইতিহাস যেখানে নারীদের বিষয়ে প্রায় নীরব, সেখানে তিনি নিজের নাম চিরস্থায়ী করে গেছেন। ‘তাযকিরাতুল আওলিয়া’র মতো গ্রন্থে তাঁর জীবনের যে অল্প বিবরণ পাওয়া যায়, তা-ই তাঁর উচ্চ মর্যাদার সাক্ষ্য দেয়।
হাসান বসরি তাঁর কাছ থেকে আত্মিক শিক্ষা নিতেন, আর তাঁর বাণী ছিল বহু সাধকের পথনির্দেশ। এমনকি শৈশবেই তাঁর প্রভাব ছিল বিস্ময়কর—এক বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নে তাঁর পিতাকে জানান যে এই কন্যার মর্যাদা এত উচ্চ যে কিয়ামতের দিন তিনি সত্তর হাজার মানুষের শাফাআত করবেন।
রাবেয়া ক্ষমতার প্রতি ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। এমনকি তিনি সুলতানের প্রদীপের আলোতে কাপড় সেলাই করতেও বিরত থাকতেন। বলতেন,
যেদিন আমি দুনিয়ার শাসকের আলো ব্যবহার করলাম, সেদিন আমার হৃদয় অন্ধকার হয়ে গেল; কাপড়টি ছিঁড়ে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি পাইনি।
এটি তাঁর কার্যকর তাওহিদের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ফাতিমা নিশাপুরি ও অচেনা উত্তরাধিকারীরা
ফাতিমা নিশাপুরি ছিলেন আরেক মহান নারী সুফি। তাঁর মর্যাদা এতই উচ্চ ছিল যে বায়েজিদ বস্তামি তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে এমন এক যুগল হিসেবে স্বীকৃতি দেন, যাঁদের কথায় গভীর প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পাওয়া যেত। যুলনূন মিসরিও তাঁর আত্মিক অবস্থান প্রশংসা করেছেন। তবুও তাঁর জীবনের খুব সামান্য অংশই ইতিহাসে সংরক্ষিত—যা নারী সুফিদের ইতিহাসে ঢাকা পড়ার বাস্তবতাই তুলে ধরে।
বশর হাফির বোনেরা
সুফি গ্রন্থে “বশর হাফির বোনেরা” নামেও কিছু নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বশর হাফি নিজেই বলতেন, আমি ধার্মিকতা শিখেছি আমার বোনের কাছ থেকে।”
এক বর্ণনায় আছে, তাঁর বোন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—গ্রীষ্মকালে সুলতানের মশালের আলোয় তুলা কাটানো কি হারাম? এই প্রশ্নেই প্রকাশ পায় এমন এক তাকওয়া, যা শাসকের সম্পদ থেকে পরোক্ষ সুবিধা নেওয়াকেও এড়িয়ে চলতে শেখায়। ইমাম আহমাদ কেঁদে ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেন—এমন তাকওয়া এই পরিবার থেকেই প্রত্যাশিত।
কুরদিয়া বিনতে আমর
কুরদিয়া বিনতে আমর, বসরা বা আহওয়াজের এক নারী সাধিকা, বলেছিলেন দুনিয়ার সম্পদের কারণে কাউকে কখনো বড় মনে করিনি, আর কোনো মুসলমানকে দারিদ্র্যের জন্য তুচ্ছ করিনি। এই দৃষ্টিভঙ্গিই গভীর আধ্যাত্মিকতার পরিচয়। ইমাম আলি (আ.) বলেন, যে ব্যক্তি ধনীর সামনে তার সম্পদের কারণে নত হয়, সে তার দ্বীনের দুই-তৃতীয়াংশ হারায়।
বুদ্ধিমান উন্মাদ’ নারীরা
ইসলামী তাসাউফে কিছু সাধক ‘উক্বালায়ে মাজানিন’—অর্থাৎ বাহ্যত উন্মাদ কিন্তু অন্তরে জ্ঞানী—নামে পরিচিত ছিলেন। আল্লাহর প্রেম তাঁদের দুনিয়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করেছিল। বেহলুল দানা তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত, তবে এই ধারার নারীরা প্রায় অজানাই রয়ে গেছেন।
রাইহানা, ইলাহা, যাক্কারা ও আফিয়া মুশতাক্বা—এমন কিছু নারী ছিলেন, যাঁদের সুফিরা ‘ওয়ালেহ’ বা ‘উন্মত্ত’ বলতেন। তুহফা’ নামের এক নারীকে তো মানসিক হাসপাতালে পর্যন্ত রাখা হয়েছিল। সেরি সাক্বতী সেখানে গিয়ে বুঝতে পারেন, তিনি উন্মাদ নন—বরং এক উন্মাতাল আরিফা। তিনি বলেছিলেন,
“যিনি আমার হৃদয়ের প্রিয়, তিনিই আমাকে তাঁর কিছু দাসের অধীনে রেখেছেন। যদি মালিক সন্তুষ্ট হন, যাব; নচেৎ ধৈর্য ধরব। এ কথায় বাহ্যিক বন্দিত্বের মাঝেও আত্মিক স্বাধীনতার অনন্য প্রকাশ ঘটে।
মাইমুনা সুদা ও আসিয়া বাগদাদিও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন; তাঁদের নাম পাওয়া যায় ‘প্রথম নারী সুফিরা’ গ্রন্থে।
ইতিহাসের আড়ালে থাকা নারী সাধিকারা
পরিচিত নারীদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী ইতিহাসের পর্দার আড়ালে রয়ে গেছেন। সামাজিক কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর কারণে তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ হয়নি, কিন্তু তাঁদের উপস্থিতি ছাড়া তাসাউফের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। অনেক মহান সুফিই এমন নারীদের ছায়ায় গড়ে উঠেছেন, যাঁদের নাম আজও অচেনা।
সমাপ্তি: আলোকিত ভবিষ্যতের পথে
ইসলামী আধ্যাত্মিকতায় নারীর প্রভাব আজও অনেকাংশে অস্পষ্ট। তবুও যে অল্প সূত্র পাওয়া যায়, তাতেই তাঁদের আত্মিক প্রতিভার দীপ্তি স্পষ্ট। রাবেয়া, ফাতিমা নিশাপুরি কিংবা بشر হাফির বোনেরা—এরা জানালা খুলে দেয় নারী সুফিদের গভীর সমুদ্রে।
এই পরিচয় কেবল শুরু। ভবিষ্যৎ গবেষণাকে যেতে হবে সেই মায়েদের, স্ত্রীদের ও বোনদের কাছে—যাঁরা ধৈর্য ও ভালোবাসায় সাধকদের আত্মিক বিকাশের জমিন তৈরি করেছিলেন। ইসলামী তাসাউফের ইতিহাস তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন নারীর প্রকৃত অবস্থান নতুন করে চিহ্নিত হবে—এক নারী, যিনি অন্ধকার কোণে নন, বরং সবসময়ই ঐশী আলোর কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত।



