জীবনের পথ | কখনও আল্লাহ সতর্ক করেন, তবে তা রোষে নয়, বরং অনুগ্রহে!
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: মানুষ প্রায়ই মনে করে অব্যাহত অনুগ্রহই আল্লাহর সন্তুষ্টির নিদর্শন। অথচ ইসলামী শিক্ষায় বলা হয়েছে—গুনাহের পরও যদি রিজিক ও অনুগ্রহ প্রবাহিত হতে থাকে, তা হতে পারে এক কঠিন সতর্কবার্তা। তাই প্রতিটি অনুগ্রহই যত্ন ও আত্মসমালোচনার দাবি রাখে; কারণ যে অনুগ্রহ মানুষকে আল্লাহ থেকে গাফেল করে, সেটিই আসলে অভিশাপ।
ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগার এক হিকমতে বলেন:
یَا ابْنَ آدَمَ، إِذَا رَأَیْتَ رَبَّکَ سُبْحَانَهُ یُتَابِعُ عَلَیْکَ نِعَمَهُ وَ أَنْتَ تَعْصِیهِ، فَاحْذَرْهُ.
হে আদম সন্তান! যখন দেখো তোমার প্রভু অবিরাম তোমার প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করছেন অথচ তুমি তাঁর অবাধ্যতায় লিপ্ত, তখন তাঁর ভয় করো।” (হিকমত ২৫)
প্রথম দৃষ্টিতে অব্যাহত অনুগ্রহ কৃতজ্ঞতা ও সৌভাগ্যের কারণ মনে হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে, গুনাহের সঙ্গে যুক্ত অব্যাহত অনুগ্রহ আসলে এক গভীর বিপদের ইঙ্গিত, আল্লাহর সন্তুষ্টির নয়।
অনুগ্রহের ধারাবাহিকতা কখনও বাহ্যিক দয়া হলেও অন্তরে তা হতে পারে পরীক্ষা কিংবা ইস্তিদরাজ—অর্থাৎ ধীরে ধীরে পতনের দিকে ঠেলে দেওয়া, অথচ মানুষ তা টেরও পায় না।
কুরআনের আয়াত
কুরআন মাজীদ এ বিষয়ে মানুষের সরল ধারণা সংশোধন করে বলছে:
فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّهُ فَأَکْرَمَهُ وَنَعَّمَهُ فَیَقُولُ رَبِّی أَکْرَمَنِ * وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَیْهِ رِزْقَهُ فَیَقُولُ رَبِّی أَهَانَنِ * کَلَّا.
মানুষ যখন তার প্রভু তাকে পরীক্ষা করে সম্মান ও অনুগ্রহ দেন, তখন সে বলে: ‘আমার প্রভু আমাকে সম্মানিত করেছেন।’ আর যখন তার রিজিক সংকুচিত করেন, তখন সে বলে: ‘আমার প্রভু আমাকে হেয় করেছেন।’ কখনোই এমন নয়।” (সূরা ফজর, আয়াত ১৫–১৭)
এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় যে অনুগ্রহ সবসময় মর্যাদার নিদর্শন নয়, যেমন সংকটও সবসময় আল্লাহর ক্রোধ নয়। আসল মাপকাঠি হলো মানুষের হৃদয়ের সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে।
মূল শিক্ষা
১.প্রতিটি অনুগ্রহই সতর্কতার দাবি রাখে।
২.যে অনুগ্রহ মানুষকে আল্লাহ থেকে গাফেল করে, তা আসলে অভিশাপ।
৩.যদি দেখি গুনাহের পরও রিজিক ও অনুগ্রহ প্রবাহিত হচ্ছে, তবে আরও বেশি করে তওবা ও ইস্তিগফার করতে হবে।
এই আয়াত মানুষের সরল ধারণাকে সংশোধন করে দেয়; কারণ অনুগ্রহ সবসময় মর্যাদার নিদর্শন নয়, যেমন সংকট ও কঠিনতা সবসময় আল্লাহর ক্রোধের নিদর্শন নয়। আসল মাপকাঠি হলো মানুষের হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন আল্লাহর সঙ্গে—যা দৃশ্যমান নয়, কিন্তু সত্যিকার অর্থে নির্ধারক।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনুগ্রহ সর্বদা যত্ন ও সতর্কতার দাবি রাখে। যে অনুগ্রহ মানুষকে আল্লাহ থেকে গাফেল করে, সেটিই আসলে অভিশাপ। যদি দেখি গুনাহের পরও রিজিক ও অনুগ্রহ প্রবাহিত হচ্ছে, তবে আরও বেশি করে তওবা ও ইস্তিগফার করতে হবে; কারণ হয়তো সেই অনুগ্রহই শেষ পরীক্ষার সূচনা।
এ কারণেই ইমাম সাদিক (আ.)-এ বিষয়ে বলেন:
إِنَّ اَللَّهَ إِذَا أَرَادَ بِعَبْدٍ خَیْراً فَأَذْنَبَ ذَنْباً أَتْبَعَهُ بِنَقِمَةٍ وَ یُذَکِّرُهُ اَلاِسْتِغْفَارَ وَ إِذَا أَرَادَ بِعَبْدٍ شَرّاً فَأَذْنَبَ ذَنْباً أَتْبَعَهُ بِنِعْمَةٍ لِیُنْسِیَهُ اَلاِسْتِغْفَارَ وَ یَتَمَادَی بِهَا وَ هُوَ قَوْلُ اَللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ: «سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَیْثُ لاٰ یَعْلَمُونَ» بِالنِّعَمِ عِنْدَ اَلْمَعَاصِی.
যখন আল্লাহ কোনো বান্দার মঙ্গল চান এবং সে গুনাহ করে, তখন তিনি তাকে শাস্তি দেন ও ইস্তিগফারের কথা স্মরণ করান। আর যখন আল্লাহ কোনো বান্দার অমঙ্গল চান এবং সে গুনাহ করে, তখন তিনি তাকে অনুগ্রহ দেন, যাতে সে ইস্তিগফার ভুলে যায় এবং গুনাহে অব্যাহত থাকে। এটাই আল্লাহর বাণীর অর্থ: ‘আমরা তাদের ধীরে ধীরে এমন পথে টেনে নেব, যা তারা বুঝতেও পারবে না। (সূরা আ’রাফ, আয়াত ১৮২; আল-কাফি, খণ্ড ২, পৃ. ৪৫২)
পাদটীকা:
১. ইস্তিদরাজ” ইসলামী সংস্কৃতিতে আল্লাহর একটি সুন্নত বা নীতি হিসেবে বিবেচিত। এর অর্থ হলো—আল্লাহ গাফিল ও বেপরোয়া গুনাহগারদের ধীরে ধীরে শাস্তির দিকে নিয়ে যান। তারা যত বেশি গুনাহ করে, আল্লাহ তাদের তত বেশি অনুগ্রহ ও প্রাচুর্য দান করেন। ফলে তারা আরও অহংকার ও গাফিলতায় ডুবে যায়। শেষপর্যন্ত এই ভ্রান্ত প্রাচুর্য তাদের জন্য কঠিন ও ভয়াবহ শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (তাফসিরে নমুনা)



