নারী গৃহকর্মী নয়, তিনি গৃহের পরিচালক: আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী
রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার নারী ও কন্যাদের সমাবেশে আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেন, নারীর অধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে— নারীর উপর জোরপূর্বক গৃহকর্ম চাপিয়ে না দেওয়া, সন্তান জন্মদানের শারীরিক-মানসিক চাপের সময়ে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং নারীর জন্য শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অগ্রগতির পথ উন্মুক্ত রাখা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নারী গৃহের পরিচালক ও প্রধান এবং সেইসব নারীদের কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত যারা স্বামীর সীমিত আয় ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির মধ্যেও দক্ষতার সঙ্গে সংসার পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
আজ বুধবার সকালে দেশটির হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যারা ইমাম খোমেনি (রহ.) হোসাইনিয়ায় উপস্থিত হয়ে ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সমাবেশের বক্তৃতায় তিনি হযরত ফাতিমা যাহরাকে ((সা.আ.)) সর্বোচ্চ গুণাবলিতে সুশোভিত এক আধ্যাত্মিক মানব হিসেবে উল্লেখ করে গৃহ ও সমাজে নারীর স্থান ও অধিকার সম্পর্কিত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেন। তিনি স্বামীদের নারীর প্রতি আচরণে করণীয় ও বর্জনীয় বিভিন্ন দিকও তুলে ধরেন।
তিনি হযরত ফাতিমা যাহরার (সা.আ.) সীমাহীন গুণাবলি— ইবাদত ও বিনয়, মানুষের জন্য ত্যাগ, বিপদে ধৈর্যধারণ, অত্যাচারিতের পক্ষে সাহসী অবস্থান, সত্যের ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ভূমিকা, গৃহস্থালি ও সন্তান লালন-পালন, এবং ইসলামের প্রারম্ভিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহে সক্রিয় উপস্থিতি— উল্লেখ করে বলেন, ইরানি নারী এই আলোকোজ্জ্বল আদর্শকে অনুসরণ করে তার পথ গড়ে নেয়।
তিনি বলেন, ইসলামে নারীর মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ ও সম্মানজনক; কুরআন নারীর পরিচিতি, ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে সর্বোচ্চ সম্মানের ভাষায় কথা বলে।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কুরআনের আয়াতসমূহ উল্লেখ করে বলেন, মানব ইতিহাস ও সভ্যতায় নারী ও পুরুষ উভয়ের ভূমিকা সমান এবং আধ্যাত্মিক কৃতিত্ব অর্জনের পথও উভয়ের জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত। তিনি বলেন, এসব সত্য তাদের ভুল ধারণাকে খণ্ডন করে যারা ধর্ম মানে কিন্তু ধর্মের গভীরতা বোঝে না—বা যারা আদৌ ধর্মে বিশ্বাস করে না।
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং অধিকাংশ প্রশাসনিক পদে নারীর অধিকার ইসলামে পুরুষের সমান। ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতি এবং আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সমানভাবে সুগম।
তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা অবক্ষয়িত সংস্কৃতি ও পুঁজিবাদ ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। ইসলামে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, পোশাক-পরিচ্ছদ, হিজাব এবং বিবাহকে উৎসাহিত করার যে বিধান রয়েছে—তার উদ্দেশ্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং সমাজে নৈতিকতা রক্ষা এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সামঞ্জস্য বজায় রাখা। এর বিপরীতে পশ্চিম নারীর মর্যাদা ও যৌন আকর্ষণের বিধ্বংসী প্রভাবকে গুরুত্ব দেয় না।
তিনি বলেন, নারী ও পুরুষ ইসলামের দৃষ্টিতে পরস্পর-পরিপূরক দুটি সত্তা— যাদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে এবং শারীরিক প্রকৃতির কারণে কিছু পার্থক্যও রয়েছে। এই দুই সত্তা একত্রে মানবসমাজের পরিচালনা, প্রজন্ম রক্ষা, সভ্যতার অগ্রগতি, সামাজিক প্রয়োজন পূরণ এবং পরিবার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। তিনি বলেন, এই ভূমিকা পালনে পরিবার গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভুল পশ্চিমা সংস্কৃতি পরিবারব্যবস্থার গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছে। অথচ ইসলামে নারী, পুরুষ এবং সন্তান—এই তিনটির অধিকার সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত।

নারীর অধিকার
তিনি বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক আচরণে ন্যায়বিচার হলো নারীর প্রথম ও মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব এই অধিকার রক্ষা করা। তিনি যোগ করেন, নারীর নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা নারীর অন্যতম মৌলিক অধিকার; পশ্চিমা পুঁজিবাদ যেখানে নারীর মর্যাদা নষ্ট করেছে, সেখানে ইসলাম নারীর প্রতি পূর্ণ সম্মানের ওপর জোর দেয়।
তিনি নবী করিম (সা.আ.)-এর একটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, নারী ‘ফুল’— তিনি গৃহকর্মী নন; তাই নারীর প্রতি রুক্ষ ভাষা ও আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। ফুলের মতো যত্ন ও সম্মানের মাধ্যমে তাকে সহায়তা করতে হবে, যাতে গৃহ তার সৌরভে ভরে ওঠে।
তিনি কুরআনে উল্লেখিত দুই মহান নারী— হযরত মরিয়ম (আ.) ও আসিয়া (ফেরাউনের স্ত্রী)—এর উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, তারা নারী-পুরুষ সকল মুমিনের জন্য আদর্শ ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেন, সমান কাজে সমান মজুরি, কর্মরত ও একক অভিভাবক নারীর বীমা, মাতৃত্বজনিত বিশেষ ছুটিসহ নারীর বহুবিধ অধিকার কোনো বৈষম্য ছাড়াই নিশ্চিত করতে হবে।
গৃহে নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার: স্বামীর ভালোবাসা
তিনি বলেন, গৃহে নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার ও প্রয়োজন হলো স্বামীর আন্তরিক ভালোবাসা। তিনি একটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, পুরুষকে তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, নারীর আরেকটি মৌলিক অধিকার হলো সহিংসতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা—এবং পশ্চিমা সমাজে প্রচলিত ‘নারী হত্যার’ মতো ভয়াবহতা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
নারী গৃহের পরিচালক ও প্রধান
তিনি বলেন, নারীর ওপর গৃহকর্ম চাপিয়ে না দেওয়া, সন্তান জন্মের কঠিন সময়ে স্বামীর সহায়তা, এবং নারীর শিক্ষা ও কর্মজীবনের অগ্রগতির পথ উন্মুক্ত রাখা—এগুলো নারীর নিশ্চিত অধিকার। এবং তিনি জোর দিয়ে বলেন: নারী গৃহের পরিচালক ও প্রধান।
তিনি বলেন, যেসব নারী সীমিত আয় ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেও দক্ষতার সঙ্গে সংসার পরিচালনা করছেন— তাদের প্রতি সমাজের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে ইসলামে নারী স্বাধীন, সক্ষম, মর্যাদাসম্পন্ন এবং অগ্রগতির অধিকারী; কিন্তু পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নারীর পরিচয়কে পুরুষের ছায়ায় লুকিয়ে ফেলে এবং তাকে ভোগের সামগ্রীতে পরিণত করে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি আলোচিত নারী-শিকারী অপরাধচক্রের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এসব পশ্চিমা ভুল দৃষ্টিভঙ্গিরই ফল।
তিনি বলেন, পুঁজিবাদ পরিবারব্যবস্থা ধ্বংস করেছে—যার ফল হলো পিতৃপরিচয়হীন শিশু, ভেঙে যাওয়া পারিবারিক সম্পর্ক, তরুণী শিকারকারী চক্র, এবং যৌনাচারের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার। তারা প্রতারণাপূর্ণভাবে এসবকে “স্বাধীনতা” বলে প্রচার করে—এমনকি আমাদের দেশেও— কিন্তু বাস্তবে এটি স্বাধীনতা নয়, বরং এক ধরনের দাসত্ব।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র পশ্চিমের ভুল যুক্তিকে বাতিল করেছে
তিনি বলেন, পশ্চিম দাবি করে যে হিজাবসহ কিছু বিধিনিষেধ নারীর অগ্রগতির পথে বাধা। কিন্তু ইসলামী প্রজাতন্ত্র দেখিয়েছে— হিজাব রক্ষা করেও নারীরা সর্বক্ষেত্রে অগ্রগতি ও নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
তিনি উল্লেখ করেন যে গত কয়েক দশকে ইরানি নারীরা বিজ্ঞান, ক্রীড়া, রাজনীতি, সমাজকর্ম, স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণা, জীবনমানের উন্নয়ন, এবং শহীদ পরিবারের সেবায় এমন সাফল্য অর্জন করেছেন— যা ইরানের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
শেষে তিনি গণমাধ্যমকে সতর্ক করে বলেন, হিজাব, নারী-পুরুষের সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করার সময় গণমাধ্যম যেন পশ্চিমা ধারণা তুলে না ধরে; বরং ইসলামের গভীর, কার্যকর ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরতে হবে— যা বিশ্বজুড়ে বহু নারীকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে।
বক্তৃতার আগে শহীদ গোলাম আলী রাশিদের স্ত্রী, শহীদ আমিন-আব্বাস রাশিদের মা, এবং শহীদ হোসেন সালামির কন্যা নারীর দায়িত্ব ও প্রয়োজনসম্পর্কিত বক্তব্য প্রদান করেন।



