জীবনযাপনবিশেষ সংবাদবিশ্বস্বাস্থ্য পরামর্শ

পরিচয়, সংলাপ ও বোঝাপড়া: দম্পতিদের মনোমালিন্য কাটানোর চাবিকাঠি

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ৩ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: পরিচয়, সংলাপ আর পারস্পরিক বোঝাপড়া—এই তিনটি জাদুকরী চাবিকাঠিই যেন দাম্পত্য জীবনের তালা খুলে দেয়। খোরাসান ইসলামিক সেমিনারির পরিবার পরামর্শ কেন্দ্রের বিশিষ্ট কনসালট্যান্ট মাহবুবে দাশ্তী বলছেন, ছোট্ট একটি ভুল বোঝাবুঝি, একটি কথা না বলে চেপে রাখা, অথবা প্রিয়জনের হৃদয়ের গোপন চাহিদা না বোঝা—এই সাধারণ ভুলগুলোই একদিন ঝড়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় সুখের সংসারকে। কিন্তু যদি সময় থাকতে যোগাযোগের সোনার সেতু বানানো যায়, তবে অনেক ঝড়ই আসার আগেই থেমে যায়।

খোরাসান ইসলামিক সেমিনারির সাংস্কৃতিক ও প্রচার বিভাগের পরিবার পরামর্শ কেন্দ্রের প্রিয় কনসালট্যান্ট মাহবুবে দাশ্তী হৃদয় খুলে বললেন, “আজকের দুনিয়ায় পারিবারিক সম্পর্ক যেন একটা জটিল গিঁট। যত দিন যাচ্ছে, গিঁট আরও শক্ত হচ্ছে। তাই যোগাযোগের শিল্প, দ্বন্দ্ব নিবারণের কৌশল এবং বিবাহের আগেই সংকট প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ—এগুলো এখন সোনার চেয়েও দামি হয়ে উঠেছে।

তিনি মুচকি হেসে আরও যোগ করলেন, ভালোবাসার সংসারে অনেক আগুনই আসলে ছাইয়ের নিচে লুকানো। সময়মতো একটু হাওয়া দিয়ে ছাই সরালে আগুন আর জ্বলে না। সঠিক শিক্ষা আর পরামর্শই সেই হাওয়া।

সবচেয়ে বড় শত্রু: অবিশ্বাসের ছায়া

মাহবুবে দাশ্তী বললেন, আজকাল দম্পতিদের মাঝে সবচেয়ে বড় বিষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে—একজনের ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া বা বাইরের যোগাযোগ নিয়ে সন্দেহ। এই সন্দেহটা যেন একটা অদৃশ্য বিষ, ধীরে ধীরে ভালোবাসার শিরায় মিশে আস্থাকে শেষ করে দেয়। ফলাফল—দুজনের মাঝে বরফের দেওয়াল, চোখে চোখে কথা নেই, হৃদয়ে হৃদয়ে দূরত্ব।”

দাম্পত্য জীবনের শান্তির চার সোনালি স্তম্ভ

তিনি আঙুলে আঙুলে গুনে বললেন, চারটি জিনিস যদি মজবুত থাকে, তবে কোনো ঝড়ই সংসারের ছাদ উড়িয়ে নিতে পারে না:

 ১. একে অপরের মনের গঠন, স্বভাব ও অনুভূতি গভীরভাবে চেনা

২. হৃদয়ের কথা মুখে প্রকাশের সাহস ও দক্ষতা বাড়ানো

৩. ঘরে প্রতিদিন একটু সময় শুধু কথা বলার জন্য রাখা—চা-নাশতা নয়, শুধুই দুজনের জন্য

৪. প্রিয়জনের গোপন চাহিদা বোঝা এবং তা পূরণে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসা

প্রতিটি দ্বন্দ্বের নিজস্ব চাবি আছে,” তিনি বললেন, আর সঠিক পরামর্শ সেই চাবি খুঁজে দেয়।

যখন ছোট্ট মেঘ বজ্রপাতে রূপ নেয়

অনেকে ভাবেন, একটা ছোট্ট কথা চেপে গেলে কী আর এমন ক্ষতি! কিন্তু সেই চাপা কথাই একদিন বিস্ফোরণ হয়,” মাহবুবে দাশ্তী আক্ষেপের সুরে বললেন। “একজনের অনুভূতিকে অবহেলা করা, ছোট বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়া—এই দুই ভুলই ছোট মেঘকে কালবৈশাখী বানায়।

বিচ্ছেদের পরে যে অন্ধকার নেমে আসে

যে পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত দুর্বল, বাসস্থান নেই, আত্মীয়-পরিজনের সাহায্য নেই—তাদের বিচ্ছেদ যেন আকাশ ভেঙে পড়া,” তিনি গভীর শ্বাস ছেড়ে বললেন। বিশেষ করে নারীরা ভয়, উদ্বেগ আর অসহায়ত্বের অন্ধকারে ডুবে যান। আর সন্তানেরা? তারা হয়ে ওঠে আগ্রাসী, আত্মবিশ্বাসহীন, একাকী অথবা অতিরিক্ত নির্ভরশীল। তাই বাবা-মা’র উচিত—বিচ্ছেদ হলেও সন্তানের মনের জন্য যেন একটা আলোর দরজা খোলা থাকে।

সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনার ছয়টি মন্ত্র

মাহবুবে দাশ্তী শেষে দম্পতিদের জন্য ছয়টি মূল্যবান উপদেশ দিলেন:

১- ইতিবাচক দৃষ্টি রাখুন, ছোট ছোট ভালো জিনিসগুলো দেখুন

২- বাস্তবতাকে মেনে নিন, স্বপ্নের ঘোড়ায় সওয়ার হবেন না

৩- মনের শক্তি বাড়ান, ছোট আঘাতে ভেঙে পড়বেন না

৪- অবাস্তব প্রত্যাশা কমান, মানুষ মানুষই থাকে

৫- জীবনকে সরল করুন, বোঝা বাড়িয়ে লাভ নেই

৬- দায়িত্বগুলো ন্যায়সঙ্গতভাবে ভাগ করে নিন

তিনি হাসিমুখে শেষ করলেন, বিবাহের সংকটের বড় অংশই আসলে প্রতিরোধ করা যায়। শুধু চাই সময়মতো দুটো জিনিস—একটি খোলা মন আর একটি সাহসী জিহ্বা। আর যদি নিজে পারা না যায়, তবে একজন দক্ষ পরামর্শকের দুয়ারে একবার টোকা দেওয়া। একটা টোকাই যথেষ্ট, যাতে পুরো সংসারটা আবার ফুলে-ফলে সাজানো হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button