ইতিহাসজীবনযাপনবিশেষ সংবাদবিশ্ব

কেন আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করি না?

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইরান-আমেরিকা বৈরিতা কোনো সাধারণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়; এ যেন দুই বিপরীতধর্মী জগতের মৌলিক সংঘাত। একদিকে ইসলামী স্বাধীনতা, অহংকার-বিরোধিতা ও জাতীয় মর্যাদার ওপর প্রতিষ্ঠিত ইরানের বিপ্লব; অন্যদিকে পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী কাঠামো। এই বিপ্লব পশ্চিমা হেজেমনিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাই ইরানের কাছে আপস মানে দুর্বলতার প্রকাশ ও পরিচয়ের বিলোপ; আর প্রতিরোধ মানে স্বাধীনতা ও সম্মানের অটুট রক্ষণ।

ইরান কেন আমেরিকার সঙ্গে আপস করে না” শিরোনামে এক গভীর বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সচেতন পাঠকদের জন্য আমরা তার সারাংশ তুলে ধরছি।

ইরানি জাতির পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে—দীর্ঘ সংগ্রাম কোনো আকস্মিক প্রতিক্রিয়া নয়। এর মূলে রয়েছে দশকের পর দশক ধরে ইরানের ওপর চাপানো অবিচার, শত্রুতা ও অপরাধের ক্ষত। আমেরিকার এই শত্রুতার কারণ যদি বোঝা যায়, তবে প্রতিরোধের অপরিহার্যতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব ঈমান ও ঐশী মূল্যবোধের ওপর প্রোথিত হয়ে বিশ্ব-অহংকারের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ভেঙে চুরমার করেছে। এটি পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং মুসলিম জাতিসমূহের মধ্যে জাগরণ ও রাজনৈতিক সচেতনতার ঝড় তুলেছে। এই কারণেই পশ্চিমা অহংকারবাদ—বিশেষ করে আমেরিকা—ইসলামি বিপ্লবকে নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে; কেননা এই বিপ্লব তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থের জন্য সরাসরি হুমকি।

 শত্রুতার মূল কারণসমূহ

১. ইসলামভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অহংকারবাদের সবচেয়ে বড় আপত্তি ইরানি বিপ্লবের ইসলামি চরিত্রের প্রতি। ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বিপ্লব পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও তার ভিত্তিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে।

রিচার্ড নিক্সন বলেছিলেন: “একবিংশ শতাব্দীতে ইসলামি জগৎ হবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্র।”

স্যামুয়েল হান্টিংটন লিখেছেন: “ভবিষ্যতের প্রধান সংঘাত হবে ইসলামি সভ্যতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার মধ্যে।”

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন: “আজ আমেরিকার ইরান-বিরোধিতার মূল কারণ ইসলাম। তারা ভয় পায় ইরানিদের মুসলিম থাকা, খাঁটি মোহাম্মদী ইসলামকে আঁকড়ে ধরে থাকা—এটাই তাদের কাছে সবচেয়ে অসহনীয়।”

২. বিশ্ব-অহংকারবাদী ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ইরানের স্বাধীন ও শক্তিশালী অবস্থান পশ্চিমা আধিপত্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।

আমেরিকার সাবেক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড মার্ফি কংগ্রেসে বলেছিলেন: “ইরানি বিপ্লব কোনো সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনা নয়; এটি এমন এক ঢেউ সৃষ্টি করেছে যা পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক—উভয় পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তিকে কাঁপিয়ে তুলেছে।”

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন: “ইসলামি বিপ্লব হলো বিশ্বের জালিম ও অহংকারী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক উচ্চারিত আক্রমণ। ঠিক এই কারণেই বিশ্বশক্তিগুলো নানাভাবে ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সমস্যা কোনো একটি বিষয়ে কঠোর অবস্থান নয়; সমস্যা হলো ইরানের মৌলিক ও নীতিগত অবস্থানই তাদের আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলে এবং বিশ্বের নিপীড়িত জাতিগুলোকে আশার আলো দেখায়।

৩. ইসলামি বিপ্লব: নিপীড়িত জাতিসমূহের জাগরণকেন্দ্র ও প্রতিরোধের অনুপম আদর্শ

ইসলামি বিপ্লবের আলোকবর্তিকা শুধু ইরানের সীমানায় আবদ্ধ থাকেনি; এটি বিশ্বজুড়ে নিগৃহীত জাতিগুলোর হৃদয়ে জাগরণের অগ্নিশিখা জ্বালিয়েছে এবং শক্তিশালী অহংকারী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে। এই বিস্তার, এই প্রভাবই যুক্তরাষ্ট্রের ইরান-বিরোধিতার অন্যতম গভীরতম কারণ।

সর্বোচ্চ নেতা বলেন: “বিপ্লবের বিজয়ের পর এত বছর অতিবাহিত হলেও আমেরিকা কখনোই ইরান, ইরানি জাতি ও ইসলামি ব্যবস্থার প্রতি শত্রুতা হ্রাস করেনি। কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট—এ অঞ্চল ছিল তাদের নিরাপদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘাঁটি। কিন্তু ইসলামি চেতনা ও দৃঢ় বিশ্বাস এ জাতিকে জাগ্রত করল, আর তারা ইসলামের বরকতে সেই লোভী, আধিপত্যকামী ও লুণ্ঠনকারী শক্তির হাত চিরতরে কেটে দিল। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে আমেরিকান অহংকারবাদকে সবচেয়ে কঠিন আঘাত এনেছে—ইসলাম। তাই তাদের ক্রোধ সবচেয়ে গভীর, তাদের প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে উন্মত্ত ও নির্মম।”

৪. স্বাধীনতা-চেতনা ও অটল অগ্রযাত্রা

ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অটুট স্বাধীনতা-চেতনা, আত্মনির্ভরতার পথে অবিচল অগ্রসরণ এবং মহাশক্তির ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্তির দুর্দমনীয় সংকল্প—এসবই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলোর বৈরিতার অন্যতম মূল উৎস।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্টিন ইন্ডাইক অসভ্য স্পর্ধায় বলেছিলেন: “ইসলামি বিপ্লবকে এমন কঠিন শাস্তি দিতে হবে যেন অন্য কোনো দেশ আর কখনো স্বাধীনতা ও আমেরিকান নেতৃত্ব থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে সাহস না করে।”

নোয়াম চমস্কি বলেন: “ইসলামি প্রজাতন্ত্র আমেরিকার কাছে অগ্রহণযোগ্য—কারণ ইরান তার স্বাধীনতা ছাড়তে রাজি নয়।”

সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন: “আমেরিকান অহংকারবাদসহ বিশ্বের যেকোনো উদ্ধত শক্তির ইরান-বিরোধিতার মূলে রয়েছে ইরানের ন্যায়ের পতাকা। তারা দেখছে, ইসলাম ও তার উচ্চ মূল্যবোধের ছায়ায় একটি জাতি দৃঢ় পদক্ষেপে জ্ঞানে-কর্মে অগ্রসর হচ্ছে—এবং এই অগ্রগতি তাদের প্রভাব ও আধিপত্যের সীমা সংকুচিত করে দিচ্ছে। যে কোনো দেশ তাদের আধিপত্যের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে স্বাধীন পথে পা বাড়ায়, তাকেই তারা ঘৃণা করে। তাদের লক্ষ্য—সম্পদশালী, কৌশলগত ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশগুলোকে শক্তি, অর্থ ও প্রতারণার জালে আটকে রাখা।

ইরান-বিরোধিতার প্রকৃত কারণ হলো—ইরানি জাতির অটল বিশ্বাস, স্বাধীনতা-চেতনা ও আত্মনির্ভরতা। তারা চায় আমরা সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি—সবকিছুতে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকি। কিন্তু যখন একটি স্বাধীনচেতা জাতি নিজের লক্ষ্য অর্জনের পথে অবিচল থাকে, তখন তারা ক্রুদ্ধ হয়। তারা তখনই সন্তুষ্ট, যখন ইরানি জাতি নিজের দীন, দুনিয়া, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি তাদের হাতে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে। কিন্তু আজ ইরানের জাতি জেগে উঠেছে—এবং এমন কোনো চাপ বা জুলুম তারা মেনে নেবে না।”

তিনি আরও বলেন: “আমেরিকা ভালো করেই জানে, ইরান যদি প্রযুক্তির শীর্ষে পৌঁছায়, তবে স্বাধীনতা, মর্যাদা ও গৌরবের আহ্বান আরও শক্তিশালী হয়ে বিশ্বে—বিশেষত মুসলিম সমাজে—প্রতিধ্বনিত হবে। এই আশঙ্কাই তাদের উদ্বিগ্ন করে।”

তিনি শেষ করেন: “এই অটল দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতাই ইরানি জাতির পরিচয়। জাতীয় মর্যাদা, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গৌরব, জ্ঞান ও অর্থনীতিতে অবিরাম অগ্রগতি এবং জালিম শক্তির সামনে মাথা না নোয়ানো—এসবই আজ সমগ্র অঞ্চলের জাতিসমূহের জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দম্ভ: ইসলামি পরিচয়ের প্রতি গভীর শত্রুতা

যুক্তরাষ্ট্রের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতি এই অবিরাম শত্রুতা কেবল ক্ষমতার লালসা নয়, বরং তাদের অহংকারী ও জালিম স্বভাবেরই প্রকাশ। একই সঙ্গে এ শত্রুতার মূলে রয়েছে ইরানের সেই ইসলামি, ন্যায়পরায়ণ ও জুলুমবিরোধী ব্যবস্থা, যা কোনো পরাশক্তির পদতলে মাথা নতো করে না।

মহান নেতা বলেছেন: “গত ত্রিশ বছরে আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যা কিছু করার ছিল, যে কোনো ষড়যন্ত্র, আঘাত কিংবা পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সবই করেছে। যদি কেউ মনে করেন কোনো একটা কাজ তারা করতে পারত কিন্তু করেনি, তবে সেটি ভুল ধারণা। তারা কিছুই বাকি রাখেনি। কখনো কখনো তারা মুখে ‘সৌহার্দ্যের’ কথা বলেছে, কিন্তু পর্দার আড়ালে সবসময় ছুরি হাতে বসে ছিল। হুমকি থেকে তারা কখনো পিছু হটেনি; তাদের আদৌ বদলায়নি।”

তিনি আরও বলেন: “কৌশলগত হাসি আর সাজানো মুখ শুধু শিশুসুলভ সরল মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে। কিন্তু যে জাতি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় পোড় খেয়েছে, যে নেতৃত্ব জেগে আছে, তাদের এই নাটক দিয়ে বিভ্রান্ত করা গেলে তা হবে চরম সরলতা, কিংবা লোভ-লালসা, কিংবা আরাম-আয়েশের নেশা। আমরা আমাদের জাতি ও দেশকে এমন বিভ্রান্তির পথে যেতে দেব না।”

ইরানের স্থির পদক্ষেপ ও প্রতিরোধের আলো

মহান নেতা বলেছেন: “আমেরিকা ভালো করেই জানে, ইরান যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছে যায়, তবে স্বাধীনতা, উন্নতা ও সাফল্যের এই আহ্বান বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে মুসলিম জাতিগুলোর হৃদয়ে আরও গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হবে। এজন্যই তারা আতঙ্কগ্রস্ত।”

তিনি আরও বলেন: “এ অগ্রগতি ইরানি জাতির দৃঢ়তা ও অবিচলতার ফল। জাতীয় মর্যাদা, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক উজ্জ্বলতা, বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে অব্যাহত অগ্রযাত্রা এবং পরাশক্তিগুলোর সামনে মাথা নত না করা, আজ এসবই পুরো অঞ্চলের জাতিগুলোর জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছে।”

শত্রুর সঙ্গে ‘সন্ধি’: বুদ্ধিমানের পথ নয়, মূর্খতার চিহ্ন

এই শত্রুতার গভীরতা ও যুক্তরাষ্ট্রের অহংকারী মানসিকতাই প্রমাণ করে যে, তাদের সঙ্গে কোনো আপোষ বা মেলবন্ধনের পথ আমাদের জন্য বন্ধ। যেমনটি ইমাম খোমেনি (রহ.) বলেছিলেন:

“তারা কখনো আমাদের সঙ্গে লড়াই বন্ধ করবে না, যতক্ষণ না আমরা নিজেদের ধর্ম ও মূল্যবোধ ত্যাগ করি। যদি আমরা ইসলামি ও বিপ্লবী নীতির সঙ্গে আপোষ করি, তবে হয়তো বিশ্ব আমাদের একটি দুর্বল, অসভ্য ও পরনির্ভরশীল জাতি হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু তাতেও তারা থাকবে ‘বড়’, আমরা থাকব ‘ছোট’; তারা ‘নেতা’, আমরা ‘চাকর’। কিন্তু আমরা কিছুতেই আমাদের ইসলামি পরিচয় ও জাতীয় মর্যাদা হারাব না।”

যুক্তরাষ্ট্রের আসল সমস্যা: ইরানের স্বাধীনতা

আমেরিকার মূল আপত্তি ইরানের স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার অটল প্রচেষ্টার প্রতি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র এমন একটি গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, যে কারও ‘নেতৃত্ব’ না নিয়ে নিজের পথে হাঁটতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই চায় না ইরান একটি মডেল হয়ে উঠুক, যে মডেল অন্য জাতিগুলোকে স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক জীবনের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করবে।

মহান নেতা বলেন: “আমাদের শত্রুরা কেবল ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গেই লড়ছে না, তারা পুরো ইরানের সঙ্গে শত্রুতা করছে। একটি প্রাচীন, স্বাধীন ও শক্তিশালী জাতিকে তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।”

ইরান যতদিন ইসলামি পরিচয় ও জাতীয় মর্যাদায় অবিচল থাকবে, ততদিন এ শত্রুতা থাকবে। আর আমরাও ততদিন এই পতাকা সমুন্নত রাখব, ইনশাআল্লাহ।

শত্রুর সঙ্গে সাজশ: বুদ্ধিমানের পথ না মূর্খের আত্মসমর্পণ?

আমাদের জাতি আজ জেগে উঠেছে। চোখের পর্দা সরে গেছে। আর তাই আমরা জানি—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো রকম আপোষ বা সাজশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ। যতদিন তাদের হৃদয়ে অহংকারের আগুন জ্বলবে, যতদিন তারা বিশ্বকে নিজেদের দাসে পরিণত করার স্বপ্ন দেখবে, ততদিন তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করা হবে নিছক আত্মপ্রবঞ্চনা।

ইমাম খোমেনি (রহ.) এই সতো বলেছিলেন, স্পষ্ট, কঠিন, অমোঘ কথায়: “তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করবে না—যতক্ষণ না আমরা নিজের ধর্ম, আমাদের মর্যাদা, আমাদের বিপ্লবী আদর্শ ত্যাগ করি। যদি আমরা ইসলামি নীতির সঙ্গে আপোষ করি, তবে তারা হয়তো আমাদের একটি দুর্বল, অসভ্য, পরনির্ভরশীল জাতি হিসেবে মেনে নেবে। কিন্তু শুধু সেই পর্যন্তই। তারা থাকবে ‘মালিক’, আমরা থাকব ‘গোলাম’; তারা ‘নেতা’, আমরা ‘ভৃত্য’। কিন্তু আমরা কখনো এই অপমান মেনে নেব না। আমাদের ইসলামি পরিচয় ও জাতীয় মর্যাদা কোনো মূল্যে হারাতে দেব না।”

যুক্তরাষ্ট্রের আসল যন্ত্রণা: একটি স্বাধীন ও মর্যাদাশীল ইরান

তাদের মূল ক্ষোভ এখানেই—ইরান নামক এই প্রাচীন জাতি আজ কারও পায়ের তলায় মাথা নোয়াতে রাজি নয়। আমরা চাই না কোনো বিদেশি ‘বড় ভাই’ আমাদের পথ দেখাক। আমরা নিজের পথে, নিজের আলোয়, নিজের আদর্শ নিয়ে হাঁটতে চাই। এই স্বাধীনতাই তাদের চোখে বিঁধছে। তারা ভয় পায় যে, ইরান যদি সফল হয়, তবে পুরো মুসলিম বিশ্ব, এমনকি নিপীড়িত জাতিগুলো বলে উঠবে: “আমরাও পারি। আমাদেরও মর্যাদা আছে। আমরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি।”

তাই তারা দিনরাত চেষ্টা করে—অর্থনৈতিক শ্বাসরোধ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, মিডিয়ার বিষোদ্গার, সামরিক হুমকি—সবকিছু দিয়ে ইরানকে হাঁটু গেড়ে বসাতে চায়। কিন্তু তারা জানে না, এ জাতি হাঁটু গেড়ে বসে না; শহীদ হয়, কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করে না।

সাজশের দুটি মুখ: আলো ও অন্ধকার

সাজশ সবসময় একরকম নয়। দুটি পথ আছে:

১. বুদ্ধিমানের সাজশ যখন দুই সমান শক্তিশালীল পক্ষ দূরদর্শিতা ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে কিছু ক্ষেত্রে আলোচনা করে, ছোটখাটো দ্বন্দ্ব মিটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। এতে কেউ পরাজিত হয় না, কেউ হারায় না নিজের পরিচয়।

২. মূর্খের আত্মসমর্পণ যখন দুর্বল বা ভীত পক্ষ শত্রুর সামনে নতজানু হয়। যখন শত্রু তোমার পরিচয়, তোমার স্বাধীনতা, তোমার মর্যাদা ধ্বংস করতে চায়, আর তুমি তার সঙ্গে “সাজশ” করো—তখন তুমি আর বেঁচে থাকো না, কেবল নিশ্বাস নাও। পারমাণবিক অধিকার ছেড়ে দেওয়া, প্রতিরক্ষা শক্তি ক্ষীণ করা, ইসলামি আইন ও বিপ্লবী আদর্শ ত্যাগ করা—এসবের নাম সাজশ নয়, এর নাম জাতীয় আত্মহত্যা।

ইতিহাসের রক্তাক্ত সাক্ষ্য

যারা আমেরিকার চাপে মাথা নোয়ালো, তাদের কী হাল হয়েছে, তা আজ পৃথিবী দেখছে: লিবিয়া ধ্বংস, ইরাক খণ্ড-বিখণ্ড, আফগানিস্তান অন্ধকারে, সিরিয়া রক্তাক্ত, মিসর আবার দাসত্বের শৃঙ্খলে। যারা “সাজশ” করেছিল, তারাই আজ কাঁদছে। আর যারা প্রতিরোধ করেছে—সে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

মহান মার্গদর্শক বলেছেন: “সাজশের মূল্য খুব বেশি। এটি একটি জাতির ভাগ্য চিরদিনের জন্য বদলে দিতে পারে। যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তারা আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।”

আমরা সেই ভুল করব না। আমরা প্রতিরোধ করব। মর্যাদা নিয়ে বাঁচব। আর যদি মরতে হয়—তাও মাথা উঁচু করে মরব। কারণ একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় গৌরব আর কিছু নেই।

 পদাটীকা

১. রিচার্ড নিক্সন, সুযোগ হাতছাড়া করো না (Seize the Moment), অনুবাদ: হোসেন ভাফসি-নেজাদ, তেহরান, পৃষ্ঠা ২৫৬

২. অনুপ্রবেশ ও রূপান্তর, পূর্বো গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৪৭

৩. দৈনিক জুমহুরি-ই ইসলামি, ১৩ ফারভারদিন ১৩৬৯ (৩ এপ্রিল ১৯৯০)

৪. হাসান ভায়েজি, ইরান ও আমেরিকা, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৩১৪; ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের উদ্ধৃতি, ষড়যন্ত্রের বিপদ, পৃষ্ঠা ৯৫

৫. মহামান্য নেতার কার্যালয়ের তথ্যকেন্দ্র, ছাত্র ও তরুণদের ‘বেলায়ত’ প্রশিক্ষণ শিবিরে মহামান্য নেতার ভাষণ, ১৭ তির ১৩৮১ (৮ জুলাই ২০০২); তেহরানের জুম’আর নামাজে মহামান্য নেতার খুতবা, ১ আজর ১৩৮১ (২২ নভেম্বর ২০০২)

৬. দৈনিক কায়হান, ২৬ ফারভারদিন ১৩৭৮ (১৫ এপ্রিল ১৯৯৯)

৭. দৈনিক রিসালাত, ২৭ অর্দিবেহেশত ১৩৮০ (১৭ মে ২০০১)

৮. মহামান্য নেতার কার্যালয়ের তথ্যকেন্দ্র, রাফসানজানের জনতার সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাতে ভাষণ, ১৮ অর্দিবেহেশত ১৩৮৪ (৮ মে ২০০৫)

৯. একই, জিহাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাতে ভাষণ, ১ তির ১৩৮৩ (২২ জুন ২০০৪)

১০. একই, সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাত, ১৪ ফারভারদিন ১৩৯০ (৩ এপ্রিল ২০১১)

১১. একই, ১৩ আবানের প্রাক্কালে ছাত্রদের সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাতে ভাষণ, ১২ আবান ১৩৮৮ (৩ নভেম্বর ২০০৯)

১২. একই, জিহাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাত, ১ তির ১৩৮৩ (২২ জুন ২০০৪)

১৩. একই, সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাত, ১৪ ফারভারদিন ১৩৯০ (৩ এপ্রিল ২০১১)

১৪. ইয়াজদ প্রদেশের ছাত্রদের সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাতে ভাষণ, ১৩ দেই ১৩৮৬ (৩ জানুয়ারি ২০০৮)

১৫. পূর্ব আজারবাইজানের জনতার সঙ্গে মহামান্য নেতার সাক্ষাতে ভাষণ, ২৮ বাহমান ১৩৯৪ (১৭ ফেবব্রুয়ারি ২০১৬)

১৬. ইমাম খোমেনি (রহ.), সহিফায়ে নূর, খণ্ড ২০, পৃষ্ঠা ২৩৭

১৭. ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর তিরোধানের ত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে মহামান্য নেতার ভাষণ, ১৪ খোর্দাদ ১৩৯৮ (৪ জুন ২০১৯)

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button