ইসরায়েলি পণ্য বর্জন: ইসলামি আলেমদের এককণ্ঠ ফতোয়া ও নৈতিক দায়বদ্ধতা
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: যখন প্রতিটি ক্রয়ই রক্তে রাঙা বুলেটে পরিণত হয়। যখন গাজার আকাশে বোমার শব্দ মিশে যায় শিশুদের কান্নায়, তখন প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি কেনাকাটা—একটি নীরব অস্ত্র হয়ে ওঠে। ইসলামি দুনিয়ার সুন্নি-শিয়া নির্বিশেষে সকল বড় আলেম, ফকিহ ও ফতোয়া পরিষদ একই সুরে ঘোষণা করেছেন: ইসরায়েলি পণ্য কেনা শুধু হারাম নয়, এটি দখলদার শত্রুকে শক্তি যোগানো—যা কুরআনের আলোকে স্পষ্ট গুনাহে কবিরা। আর এই বর্জন কেবল রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়—এটি প্রতিরোধের জিহাদ, ঈমানের দায়িত্ব, ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত মাটির প্রতি ভালোবাসার ভাষা।
আলেমদের এককণ্ঠ ঘোষণা
ফিলিস্তিনি আলেম পরিষদ (হাইয়াতু’ল উলামা ফিলাস্তিন) “যে শত্রু মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এবং আল-আকসাকে দখল করে আছে, তার সঙ্গে কোনো অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখা হারাম। বয়কট শুধু বৈধ নয়, এটি প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের অংশ।
আল-আজহার শরিফ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর উপর ফরজ যে, তারা ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের অভিযানে শরিক হবে—আল-আকসা ও জেরুজালেমের সম্মান রক্ষার্থে।
মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানী (দেওবন্দ) “কেউ বলে, ‘এক কাপ কফি থেকে ইসরায়েলের লাভ তো নগণ্য।’ আমি বলি—যদি তোমার বাবাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীর পকেটে তোমার একটি পয়সাও যায়, তুমি কি তা সহ্য করবে? তবে গাজার শিশুদের হত্যাকারীর পকেটে তোমার অর্থের একটি কণাও যাক—কেন সহ্য করবে?”
শেখ ড. ইউসুফ আল–কারাদাভি (রহ.) “প্রতিটি ডলার যা ইসরায়েলি পণ্যে ব্যয় হয়, তা ফিলিস্তিনি ভাইয়ের বুকে গুলি হয়ে ফিরে আসে। এই লেনদেন হারাম, আর বয়কট ওয়াজিব।”
মুসলিম ওয়ার্ল্ড উলামা ইউনিয়ন “কুরআন ও সুন্নাহর অসংখ্য দলিল প্রমাণ করে—দখলদার ও অত্যাচারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা শুধু জায়েজ নয়, ফরজ। আর এই ফরজ ইসরায়েলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরে প্রযোজ্য।”
ইরানের আহলে সুন্নাত আলেমগণ (শতাধিক স্বাক্ষরিত ফতোয়া) “ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীকে যেকোনো প্রকার সাহায্য—সামরিক হোক বা অর্থনৈতিক—স্পষ্ট হারাম।”
শরিয়তের আলোকে কেন হারাম?
১. কুরআনের নিষেধ সূরা মায়িদাহ (৫:২): “তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরের সাহায্য করো না।”
২. ফিকহের সর্বসম্মত নীতি “যে কাজের মাধ্যমে শত্রুর শক্তি বৃদ্ধি পায়, তা হারাম।” ইসরায়েলের প্রতিটি পণ্য—তা কমলা হোক বা টেকনোলজি—দখলদার সেনাবাহিনীর গোলায় পরিণত হয়।
৩. ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত নবী (সা.)-এর যুগে থুমামা ইবনে উসাল (রা.) মক্কার কাফিরদের জন্য খাদ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আজ আমরা যদি একটি কোমল পানীয়ও কিনি, তবে আমরা সেই একই শত্রুকে শক্তি দিচ্ছি।
শেষ কথা: এই বয়কট কেবল অস্ত্র নয়, এটি ঈমানের ভাষা
যখন তুমি একটি ইসরায়েলি পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকো, তখন তুমি কেবল একটি পণ্য ফেলে দাও না— তুমি একটি বোমা নিষ্ক্রিয় করো, একটি শিশুর চোখের জল মোছো, আল-আকসার সম্মানের পক্ষে একটি ভোট দাও।
এই বর্জন কোনো কঠিন জিহাদ নয়। এটি সবচেয়ে সহজ জিহাদ—যেখানে অস্ত্র হলো তোমার পকেট, তোমার সিদ্ধান্ত, তোমার ঈমান।
হে মুমিন! তোমার প্রতিটি কেনাকাটা এখন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন: “আমি কার পকেটে টাকা দিচ্ছি—যে আমার ভাইকে হত্যা করছে, নাকি যে আমার ভাইকে বাঁচাতে চায়?
আল্লাহ আমাদের সকলকে এই সহজ জিহাদে অবিচল রাখুন। আমিন।
পাদটীকা
১. আয়ূব শাফেয়ীপুর, «শিয়া ও সুন্নি ফিকহের দৃষ্টিতে ইসরায়েলি পণ্য ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার ফিকহি ভিত্তি»।
২. সংগৃহীত: ফিলিস্তিনি আলেম পরিষদের ওয়েবসাইট — www.palscholars.org
৩. উদ্ধৃত: মুসলিম ওয়ার্ল্ড ইউলেমা ইউনিয়নের ওয়েবসাইট — www.iumsonline.org
৪. উদ্ধৃত: ফিলিস্তিনি আলেম পরিষদের ওয়েবসাইট — www.palscholars.org
অতিরিক্ত সূত্র: পাকিস্তানের সংবাদ-পোর্টাল WENews — www.wenews.pk
৫. শায়খ ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, ফিকহুল জিহাদ, খণ্ড ২, পৃ. ১২৩৪।
৬. শায়খ ড. ইউসুফ আল-কারযাভীর সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফতোয়া নং ১৮২১ — www.al-qaradawi.net
৭. শায়খ ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, ফাতাওয়া মু’আসিরাহ (সমকালীন ফতোয়াসমগ্র), খণ্ড ৩, পৃ. ২০৭।
৮. সংগৃহীত: আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ওয়েবসাইট — www.azhar.eg
৯. সংগৃহীত: ভারতের ইসলামি ফিকহ একাডেমির ওয়েবসাইট — www.ifa-india.org
১০. দ্রষ্টব্য: সুন্নি মাদ্রাসা শিক্ষা পরিকল্পনা পরিষদের সচিবালয়ের ওয়েবসাইট — www.dmsonnat.ir



