ইতিহাসজীবনযাপনবিশেষ সংবাদবিশ্ব

হজরত উম্মুল-বানীন (সা.) : আলোকবর্তিকা যিনি ঈমানের সৌরভে ভরিয়ে দিয়েছিলেন একটি ঘর

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামের ইতিহাসে কিছু নারী আছেন, যাঁদের নাম উচ্চারণ করলেই অন্তর আপনা-আপনি আলোকিত হয়ে ওঠে। তাঁদের জীবন এমন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা শতাব্দী পেরিয়ে এসেও আজকের নারী-পুরুষ, মা-বাবা, সন্তান—সকলের জন্য পথ দেখায়। হুজ্জতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন হোসেইন রেদায়ী এই মহীয়সী নারীর জীবনকে বলেছেন “ঈমান, ফিদা, পরিবার-পরিচর্যা ও ধর্মীয় শিক্ষার এক অনন্য উদাহরণ”। তিনি হজরত উম্মুল-বানীন ফাতেমা বিনতে হিজাম (সা.)।

তাঁর জীবন যেন একটি সুগন্ধময় বাগান—যেখানে ফুটেছিল বিশ্বস্ততার পুষ্প, ধৈর্যের সৌরভ, সন্তান-ভালোবাসার মধুর ফল আর আহলে বাইতের প্রতি অকৃত্রিম ফিদায়তের অমলিন আলো।

সন্তান-লালনের সুরভিত পাঠশালা

হজরত উম্মুল-বানীন (সা.) যখন ইমাম আলী (আ.)-এর ঘরে পা রাখেন, তখন সেই ঘরে ছিলেন হাসান ও হোসেইন—দুটি অসুস্থ শিশু, যাঁরা সবে মাতৃহারা হয়েছেন। তিনি ঘরে ঢুকেই ছুটে গেলেন তাঁদের শয্যাপার্শ্বে। সেদিন থেকে তিনি শুধু স্ত্রী নন, হয়ে উঠলেন এক মমতাময়ী মা। তিনি নিজেই ইমাম আলী (আ.)-কে বললেন, “আমাকে আর আমার আসল নামে ডাকবেন না। আমাকে ডাকুন ‘উম্মুল-বানীন’—চার ছেলের মা। যেন হাসান, হোসেইন ও জয়নাব আমার নাম শুনে তাঁদের প্রিয় মা ফাতেমা (সা.)-এর স্মৃতিতে আঘাত না পান।”

এই একটি কথাতেই ফুটে ওঠে তাঁর হৃদয়ের গভীরতা, ত্যাগের উচ্চতা আর ফাতেমা যাহরা (সা.)-এর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা।

স্বামী-ভক্তি ও আনুগত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

ইমাম আলী (আ.)-এর অন্য কোনো স্ত্রী যে মর্যাদায় পৌঁছাতে পারেননি, সে কথা ইতিহাস নিজেই সাক্ষ্য দেয়। তিনি ছিলেন সাহসী, ফিদায়ি, অতুলনীয় আত্মিক মহিমায় উদ্ভাসিত। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল যুগের ইমামের প্রতি অবিচল আনুগত্য আর ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন নিজের সন্তানদের অন্তরেও। ফলশ্রুতিতে জন্ম নিয়েছিলেন হজরত আব্বাস (আ.)—কারবালার চাঁদ, বিশ্বস্ততার প্রতীক, সাহসের স্তম্ভ।

কারবালার পরও যে ধৈর্য আকাশ ছুঁয়েছিল

কারবালার রক্তাক্ত ময়দান থেকে যখন খবর এলো চার ছেলেই শহাদাত বরণ করেছেন, তখনো তিনি ভেঙে পড়েননি। প্রতিদিন তিনি মদিনার বাকী গোরস্থানে যেতেন, চারটি প্রতীকী কবর তৈরি করতেন আর এমন হৃদয়বিদারক মাতম করতেন যে, পথচারী মারুফ-মুনকার, শত্রু-মিত্র সবাই অশ্রুসজল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। তাঁর কান্না ছিল শুধু সন্তানহারা মায়ের কান্না নয়, ছিল ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বিপ্লবের বার্তাকে জিন্দা রাখার অশ্রু-সোপান।

আজকের প্রজন্মের জন্য উপেক্ষিত আলোকবর্তিকা

হুজ্জতুল ইসলাম রেদায়ী গভীর দুঃখের সাথে বলেছেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে হজরত উম্মুল-বানীন (সা.)-এর এই অমূল্য জীবনাদর্শ যথাযথভাবে প্রচারিত হয়নি।”

তিনি যেন একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠশালা—যেখানে শেখানো হয় সত্যের পথে ফিদায়ত, স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য, সন্তানদের মানবিক ও ইসলামী মূল্যবোধে গড়ে তোলা, গৃহ-পরিচালনায় দক্ষতা, ধৈর্য ও অটলতা। আজকের মায়েরা যদি এই পাঠশালা থেকে একটি পাতাও গ্রহণ করেন, তবে তাঁদের সন্তানেরাও হতে পারে আব্বাসের মতো বিশ্বস্ত, হোসেইনের মতো সাহসী।

হে উম্মুল-বানীন! তোমার প্রতিটি পদচিহ্ন আজও আলো ছড়াচ্ছে। তোমার ধৈর্য, তোমার ভালোবাসা, তোমার ফিদায়ত—এই অন্ধকার যুগের পথিকদের জন্য পথ দেখাক। তোমার নামে সালাম, তোমার স্মৃতিতে অশ্রু, তোমার আদর্শে প্রতিজ্ঞা।

আল্লাহ আমাদের সকলকে তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button