ন্যায়ের নিঃসঙ্গতার অন্তরঙ্গ প্রতিধ্বনি
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: ফাদাকের প্রসঙ্গ এবং হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর শাহাদাত কেবল ইতিহাসের দুটি পৃথক অধ্যায় নয়; বরং ক্ষমতা, ন্যায় ও ঐশী মানদণ্ডের মধ্যেকার সংঘাতকে উন্মোচিত করার এক গভীর মা’রিফাতের চাবিকাঠি। যাহরা (সা.আ.) মাটির টুকরো ফিরিয়ে নিতে দাঁড়াননি; তিনি দাঁড়িয়েছিলেন ন্যায়ের মৌলিক ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। আর তাঁর শাহাদাত সেই রাজনৈতিক বিচ্যুতির বিরুদ্ধে এক অবিরাম, জীবন্ত এবং রক্তিম প্রতিবাদ হয়ে ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে আছে।
ফাদাক ও শাহাদাত: দুটি ঘটনা নয়, একটি চিরন্তন প্রতিবাদের দুটি মুখ
ফাদাক ও শাহাদাতের সম্মিলিত পাঠ আমাদের এক গভীর সত্যের সামনে এনে দাঁড় করায়: ইতিহাসের প্রবাহে ফাতেমা (সা.আ.) “মা’রিফাতনির্ভর হক-অন্বেষণের” জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি। তিনি জমি ফিরে চাননি; তিনি চেয়েছিলেন ক্ষমতার ভিত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক ঐশী মানদণ্ড। যখন সেই মানদণ্ড খিলাফতের মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো, তখন তাঁর শাহাদাত রূপ নিল এক শাশ্বত, রক্তে লেখা প্রতিবাদ-নথিতে।
বিশিষ্ট লেখক উস্তাযা নুজুম সালেহী লিখেছেন:
রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ইন্তেকাল-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দুটি ঘটনা অসামান্য তাৎপর্য বহন করে—ফাদাক এবং ফাতেমা (সা.আ.)-এর শাহাদাত। এদের বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল হয়; এরা একই মা’রিফাতি সংঘর্ষের দুটি দৃশ্যমান প্রকাশ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নবী-পরবর্তী খিলাফতের প্রকৃত চেহারা আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়।
ঐতিহাসিক সূত্রে ফাদাক কেবল এক খণ্ড জমি নয়; এ হলো “ঐশী হক” ও “রাজনৈতিক ক্ষমতা”র মধ্যেকার সীমারেখার দৃশ্যমান প্রতীক। ফাতেমাতুয যাহরা (সা.আ.) তাঁর অমর ফাদাকীয়া খুতবায় কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে নিজের বৈধ অধিকার তুলে ধরেন বটে, কিন্তু তাঁর গভীরতম লক্ষ্য ছিল ন্যায়ের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং বেলায়তকে সেই ন্যায়ের সঙ্গে অভিন্ন করে তোলা। বলা যায়, তিনি একটি “অর্থনৈতিক দাবি”কে রূপ দিয়েছিলেন “রাজনৈতিক বিচ্যুতি” উন্মোচনের অস্ত্রে। ফাদাক তাই কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল না; ছিল নবী-পরবর্তী ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে এক গভীর, যুক্তিগর্ভ ও নীরব যুদ্ধ।
আহলে সুন্নাতের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ—ইবনে কুতাইবা, ইবনে সা’দ, বালাযুরী—সবাই স্বীকার করেছেন যে, ফাদাক কেড়ে নেওয়া ও তার পরবর্তী আঘাতের ফলেই ফাতেমা (সা.আ.) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত খিলাফতের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট থাকেন। শিয়া-সুন্নি বর্ণনার এই বিরল মিলই প্রমাণ করে যে, ফাতেমা (সা.আ.)-এর মযলুমিয়াত কোনো একপক্ষীয় বয়ান নয়; বরং ইতিহাসের বহুস্বরে লিখিত এক অকাট্য সত্য।
এই দুই অক্ষ—ফাদাক এবং শাহাদাত—আমাদের স্পষ্ট বলে যায়: ফাতেমা (সা.আ.) ইতিহাসের পাতায় শুধু একজন নারী নন; তিনি “হক-অন্বেষণের মা’রিফাতি প্রতীক”। তাঁর সংগ্রাম জমির জন্য ছিল না; ছিল ঐশী মানদণ্ডকে ক্ষমতার ভিত্তিতে ফিরিয়ে আনার জন্য। আর যখন সেই মানদণ্ড সরিয়ে দেওয়া হলো, তখন তাঁর শাহাদাত হয়ে উঠল রাজনৈতিক বিচ্যুতির বিরুদ্ধে এক শাশ্বত, রক্তে লেখা প্রতিবাদ।
ফাদাক ও শাহাদাতের পুনর্পাঠ কেবল অতীতের দিকে তাকানো নয়; আজকের সমাজ-রাজনীতির জন্য এক সতর্ক দর্পণ।
মূল প্রশ্নটি আজও জ্বলজ্বল করছে: ইতিহাসে যখন ফাতেমা (সা.আ.) নিজেই হক ও ন্যায়ের মাপকাঠি হয়ে উঠেছিলেন—তখন আজ আমাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সিদ্ধান্তের মাপকাঠি কী?
সম্ভবত ফাতেমী চেতনার পুনর্জাগরণ সেখান থেকেই শুরু—যেখানে আমরা আবার ফিরে যাব ফাতেমা (সা.আ.)-এর পথে, তাঁর মানদণ্ডে, তাঁর প্রতিবাদে।



