জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

ইনসানের ২৫০ বছরের দৃষ্টিতে ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবন কেবল ব্যক্তিগত পবিত্রতা ও আত্মিক উজ্জ্বলতার গল্প নয়; বরং তা এক সর্বাঙ্গসুন্দর, সংগ্রামময় ও বহুমাত্রিক আদর্শ—যেখানে রাজনৈতিক সাহস, সামাজিক দায়বদ্ধতা, জিহাদি চেতনা এবং আধ্যাত্মিক গভীরতা একই সুতোয় গাঁথা। ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য উৎস এবং আহলে বায়েতের পবিত্র বর্ণনাসমূহ এক বাক্যে সাক্ষ্য দেয় যে, এক তরুণী হয়েও তিনি নেতৃত্ব, ত্যাগ, ইবাদত, পারিবারিক দায়িত্ব, সমাজ-সংস্কার এবং ইমামতের প্রতিরক্ষায় এমন অলৌকিক ভূমিকা পালন করেছেন যা মানবজাতির জন্য চিরন্তন আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। “ইনসানে দুসো পঞ্জাহ সালেহ” গ্রন্থের আলোকেও এই সত্য উদ্ভাসিত।

ফাতেমিয়া স্মৃতিময় এই দিনগুলোতে আমাদের একটিমাত্র উদ্দেশ্য: নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উৎস থেকে যাহরা (সা.আ.)-এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সংগ্রামের সত্য চিত্র তুলে ধরা—যাতে প্রথম ইসলামের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের হৃদয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং আমরা বুঝতে পারি যে, মানবসভ্যতা একত্রে ঋণী ফাতেমা (সা.আ.)-এর কাছে—যেমন ঋণী কুরআন, নবুওয়ত ও ইসলামের কাছে।

আমাদের উচিত এই নূরের কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হওয়া। কেননা নূরের কাছে গেলে আত্মাও নূরময় হয়—শুধু ভালোবাসার দাবিতে নয়, বরং সেই ভালোবাসা যে আমল, আচরণ ও আখলাক দাবি করে তার মাধ্যমে। শুধু মুখে “আমি শিয়া” বললেই আহলে বায়েতের সান্নিধ্য লাভ হয় না; তাঁদের পথে চলা ও তাঁদের আদর্শে নিজেকে রাঙানোই প্রকৃত কুরবত। “উম্মে আবীহা” (পিতার জননী) উপাধি তাঁর সেবা, ত্যাগ ও জিহাদেরই প্রতিচ্ছবি।

মক্কার কঠিন দিনগুলোতে, বিশেষত শিবে আবি তালিবের অবরোধে এবং হযরত খাদীজা ও হযরত আবু তালিব (আ.)-এর ইন্তেকালের পর যখন রাসূলে পাক (সা.)-এর হৃদয়ে এক অকথ্য একাকিত্ব নেমে আসে, সেই অন্ধকারময় মুহূর্তে কোমল হাতে ফাতেমা (সা.আ.) পিতার হৃদয়ের ধূলি মুছে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই তিনি “পিতার জননী” নামে ভূষিত হন।

নবী করীম (সা.) শুধু নেতৃত্ব দানে নিয়োজিত ছিলেন না; সংকটের মুখে রিসালাতের সত্যতা প্রমাণ করাও ছিল তাঁর দায়িত্ব। সেই মানসিক চাপের ভারাক্রান্ত সময়ে ফাতেমা (সা.আ.) ছিলেন তাঁর সান্ত্বনাদাত্রী, পরামর্শদাত্রী ও সেবিকা। নবীজির তাঁর হাতে চুম্বন ছিল কেবল পিতৃ-স্নেহ নয়; ছিল তাঁর মালাকুতি মর্যাদা ও আসমানি মাহাত্ম্যের স্বীকৃতি।

এক তরুণী হয়েও তিনি ছিলেন নূরের সত্তা, খোদার মনোনীত সালেহা নারী ও মানবতার শ্রেষ্ঠতম প্রতীক। যারা যুগে যুগে নারীকে শুধু সাজ-সজ্জা ও জাগতিক প্রলোভনের পুতুল বানাতে চেয়েছে, ফাতেমা (সা.আ.)-এর রুহানি সূর্যের সামনে তাদের যুক্তি তুষারের মতো গলে যায়। ইসলাম ফাতেমা (সা.আ.)-কেই নারীমহিমার চূড়ান্ত আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করে—জ্ঞানে, খিতাবায়, জিহাদে, মাতৃত্বে, স্ত্রীত্বে, হিজরতে ও সামাজিক প্রভাবে।

একদিকে তিনি ছিলেন ঘরের স্নেহময়ী স্ত্রী ও মা; অন্যদিকে নবীজির ওফাত-পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটে মসজিদে দাঁড়িয়ে যে দুর্দান্ত খুতবা দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় আজও জ্বলজ্বল করে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন রাতের নিবিড় নীরবতায় সিজদায় ডুবে থাকা আবেদা—যাঁর মুনাজাত ও খুশু-খুজু আজও আসমান-জমিন কাঁপায়। এই তিন মাত্রা—পারিবারিক দায়িত্ব, সামাজিক-রাজনৈতিক জিহাদ এবং রুহানি ইবাদত—একই ব্যক্তিত্বে এত নিখুঁতভাবে মিলিত হয়েছে যে, তা সৃষ্টির ইতিহাসে বিরল।

ইসলামের দৃষ্টিতে এ তিনটি ক্ষেত্র পরস্পর-বিরোধী নয়; বরং মানবীয় পরিপূর্ণতার তিন দিগন্ত। যাহরা (সা.আ.)-এর রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব এতই উজ্জ্বল যে, বিশ্বের সকল সংগ্রামী নারী তাঁর কাছে শিক্ষা ও প্রেরণা খুঁজে পান। বিজ্ঞান ও বাগ্মিতায়ও তিনি ছিলেন অতুলনীয়; ‘আল্লামা মাজলিসী (রহ.) বলেছেন, তাঁর ফাদাকীয়া খুতবা হলো এমন এক অমর কাব্য যার ফাসাহাত ও বালাগাত নহজুল বালাগার শ্রেষ্ঠ বাণীর সঙ্গে পাল্লা দেয়।

তাঁর সমগ্র জীবন ছিল পরিশ্রম, জিহাদ, আত্মত্যাগ ও পারিবারিক দায়িত্বের অপূর্ব সম্মিলন। হযরত আলী (আ.)-এর যুদ্ধব্যস্ত জীবনেও তিনি ঘর সামলেছেন, সন্তান লালন করেছেন, মুসলমানদের সাহায্য করেছেন। হাসান, হুসাইন ও জয়নাবের মতো আসমানি ব্যক্তিত্ব তিনিই গড়ে তুলেছেন।

দুনিয়ার সাজ-সজ্জা তাঁর অন্তরে স্থান পায়নি; তাঁর জীবন ছিল ইসলাম, বেলায়ত ও হকের পক্ষে এক অবিচল জিহাদ। তাঁর ইফফাত, ঈসার, মাতৃ-স্নেহ, সখাওয়াত ও রুহানিয়াত—এ সব মিলেই গড়ে উঠেছে সেই নারী যাকে ইসলাম আদর্শ নারী হিসেবে মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করতে চায়।

উৎস: ইনসানে ২৫০ সালেহ – হযরত আয়াতুল্লাহ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী (হাফি.)-এর বয়ানসমগ্র ।

আরও পড়ুন 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button