কুরআনের ব্যাখ্যা: ’আলে-ইমরান’ কারা?
ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫
মিডিয়া মিহির: হযরত মূসা (আ.)–এর পিতা ‘ইমরান’ এবং হযরত মরিয়ম (আ.)–এর পিতা ‘ইমরান’—দু’জনেই বনী–ইসরাঈলের বংশোদ্ভূত হলেও ভিন্ন ভিন্ন যুগে, ভিন্ন ভিন্ন গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছেন। ইসলামী উৎসে তাঁদের বংশপরিচয় ও নবুওয়াতের অবস্থান বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। নিচে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আলোচনা করা হলো।
হযরত মূসা (আ.)–এর পিতা ইমরান এবং হযরত মরিয়ম (আ.)–এর পিতা ইমরান—দু’জনেই বনী–ইসরাঈল জাতিভুক্ত ছিলেন। তবে তাঁরা পৃথক গোত্রের এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন শতকে বাস করতেন।
এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি বহুদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে—মূসার পিতা ইমরান ও মরিয়মের পিতা ইমরান—তাঁদের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক কী? তাঁরা কি নবী ছিলেন?
ইসরাঈল হলো হযরত ইয়াকুব (আ.)–এর উপাধি; তাই তাঁর বংশধরদের বলা হয় বনী–ইসরাঈল। হযরত ইয়াকুব (আ.)–এর বারো পুত্র ছিল—যা কুরআনে উল্লেখিত। হযরত ইউসুফ (আ.) স্বপ্নে দেখেছিলেন—এগারোটি নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্র তাঁর সামনে সেজদা করছে। বহু বছর পর যখন তাঁর পিতা–মাতা ও একাদশ ভাই মিশরে এসে তাঁকে সেজদা করলেন, তিনি সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা স্মরণ করালেন।
এভাবে বোঝা যায়, ইউসুফ (আ.)–এর ভাই ছিলেন এগারো জন, আর তাঁকে মিলিয়ে মোট বারো জন। ইসলামী উৎসে এই বারো ভাইয়ের নামও উল্লেখিত হয়েছে।
এই বারো জনের বংশ থেকেই গঠিত হয় বনী–ইসরাঈলের বারোটি গোত্র—এবং প্রতিটি গোত্র তাঁদেরই নামে পরিচিত।
মূসা (আ.)–এর বংশপরিচয়
ইসলামী গ্রন্থ অনুযায়ী, হযরত মূসা (আ.) ছিলেন ইমরান–এর পুত্র, আর ইমরান ছিলেন ইসহর–ইসহার, পুত্র মাহেস, পুত্র লাবি, পুত্র ইয়াকুব (আ.)। অর্থাৎ মূসা (আ.) লাবির গোত্রভুক্ত—যিনি ইউসুফ (আ.)–এর ভাইদের একজন।
মরিয়ম (আ.)–এর বংশপরিচয়
হযরত মরিয়ম (আ.)–এর পিতা ছিলেন ইমরান, যিনি বনী–ইসরাঈলের একজন নবী ছিলেন এবং মূসার পিতা ইমরানের প্রায় ১৮ শতক পর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আশহাম ইবনে আমুন, যার বংশধারা হযরত দাউদ (আ.) ও সুলাইমান (আ.)–এর দিকে গিয়ে পৌঁছায়। অর্থাৎ মরিয়ম (আ.)–এর পিতা ইমরান ইয়াহুদা গোত্রের, আর এই গোত্রও হযরত ইয়াকুব (আ.)–এর পুত্রদের বংশধর।
সুতরাং দেখা যায়—
১.মূসা (আ.)–এর পিতা ইমরান: লাবির গোত্র
২.মরিয়ম (সা.)–এর পিতা ইমরান: ইয়াহুদা গোত্র
দু’জনেই ইবরাহিম (আ.)–এর বংশধর, অর্থাৎ একই মহামানবিক বংশের অন্তর্ভুক্ত হলেও ভিন্ন কালের এবং ভিন্ন গোত্রের মানুষ।
আলে ইমরান” সম্পর্কে কুরআনের ব্যাখ্যা : কুরআনে বলা হয়েছে:
আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহিমের পরিবার ও ইমরানের পরিবারকে বিশ্বমানবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এই আয়াতে “আলে ইমরান” বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে—এ নিয়ে তিনটি ব্যাখ্যা প্রচলিত:
১.কেউ বলেন—এতে বোঝানো হয়েছে মূসা (আ.) ও তাঁর পরিবারকে।
২.আরেকদল বলেন—এতে ইঙ্গিত রয়েছে ইমরান—হযরত আলী (আ.)–এর পিতা (যদিও তাঁর পরিচিত নাম ‘আবু তালিব’)।
৩.আরও অনেকে বলেন—এতে বোঝানো হয়েছে মরিয়ম (আ.) ও ঈসা (আ.)–এর পরিবারকে; আল্লামা তাবাতাবায়ী এই ব্যাখ্যাকে সর্বোত্তম বলেছেন।
আলোচনার সারমর্ম হলো—যেহেতু কুরআনে প্রথমেই “আলে ইবরাহিম”–এর কথা এসেছে, তাই তিনটি ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত হতে পারে। কারণ তিনজন ইমরানই—মূসা (আ.)–এর পিতা, মরিয়ম (আ.)–এর পিতা এবং আলী (আ.)–এর পিতা—সকলেই ইবরাহিম (আ.)–এর বংশধর এবং আল্লাহর মনোনীত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।
পাদটীকা
১) সূরা ইউসুফ, আয়াত ৪
২) সূরা ইউসুফ, আয়াত ১০০
৩) আল্লামা মল্লা মুহাম্মদ বাকির মাজলিসি, বিহারুল আনওয়ার, বেইরুত: দারু ইহইয়াউত-তুরাসিল আরাবি, তৃতীয় সংস্করণ, ১০৪৩ হিজরি, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ২২০।
৪) বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ১২০।
৫) একই গ্রন্থ, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ১৯৪।
৬) মল্লা ফাতহুল্লাহ কাশানী, মিনহাজুস সাদেকীন, ইসলামী বইঘর, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৪৪ হিজরি শামসি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২১২।
৭) সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৩।
৮) ফজল ইবনে হাসান তাবারসি, মাজমাউল বায়ান (দলগত অনুবাদ), তেহরান: ফারাহানী প্রকাশন, প্রথম সংস্করণ ১৩৫০–১৩৬ হিজরি শামসি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪১; এবং আল-মীযান–এর অনুবাদ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৬২।
৯) আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হুসাইন তাবাতাবায়ী, আল-মীযান (অনুবাদ: মুহাম্মদ বাকির মুসাভি হামাদানি), কোম: জামেয়াতে মুদাররেসিনে হাওজায়ে ইলমিয়ায়ে কোম, ১৩৬৩ হিজরি শামসি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৬২।
উৎস:কেন্দ্র—কোম, ইসলামি চিন্তাধারা গবেষণা ও প্রশ্নোত্তর বিভাগ।



