ইতিহাসজীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

মানুষের সঙ্গে দায়িত্বশীলদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত— ইমাম সাদিক (আ.)–এর রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষা

রাসেল আহমেদ | প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

মানুষের সঙ্গে দায়িত্বশীলদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত— ইমাম সাদিক (আ.)–এর রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষা; আয়াতুল্লাহ আল-উজমা শুবেইরী জান্জানীর ব্যাখ্যা

 

মিডিয়া মিহির: ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর প্রেরিত চিঠিগুলো বিশেষ মর্যাদা রাখে। এর মধ্যে আহওয়াজের গভর্নর আবদুল্লাহ নাজ্জাশীর প্রতি ইমাম (আ.)-এর চিঠিটি এমন এক অনন্য দলিল, যা ন্যায়ভিত্তিক শাসন, মানবিক রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজকল্যাণের গভীরতম মূল্যবোধকে এক আলোকচ্ছটায় উপস্থাপন করেছে। আয়াতুল্লাহ আল-উজমা শুবেইরী জান্জানী তাঁর এক বক্তৃতায় এই চিঠিটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে সঠিক আচরণ এবং শাসকের দায়িত্ব সম্পর্কে অনবদ্য শিক্ষা তুলে ধরেছেন।

শাসনভার—একদিকে সুসংবাদ, আবার ভয়ও

ইমাম সাদিক (আ.) চিঠির শুরুতেই নাজ্জাশীর শাসক নিযুক্ত হওয়াকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করেন:

  • সুসংবাদ, কারণ হয়তো আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে আলে-মুহাম্মাদের (আ.) দুঃখভার লাঘব করবেন, দুর্বলদের শক্তি দেবেন, অভাবীদের অভিভাবকত্ব করবেন এবং শত্রুর আগুন নিবারণ করবেন।

  • ভয়, কারণ ক্ষমতার একটি মাত্র ভুল—বিশেষত আল্লাহর বন্ধুদের ব্যাপারে—এমন পরিণতি ডেকে আনতে পারে যে মানুষ জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না।

ক্ষমতার দ্বিমুখী বাস্তবতা—সুযোগ ও ভয়—এত সংক্ষেপে, অথচ এত গভীরভাবে খুব কমই ব্যক্ত হয়েছে।

ন্যায় ও মানবিকতা: সফল রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি

ইমাম (আ.) রাষ্ট্রনেতার জন্য যে মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন, তা সময়-অতিক্রমী এবং সর্বজনীন:

১. রক্তপাত থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর বন্ধুদের কষ্ট না দেওয়া

শাসকের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব—মানুষের জীবন, সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষা।

২. প্রজাদের সঙ্গে কোমলতা ও সদাচরণ

“নরম হও—কিন্তু দুর্বল না; কঠোর হও—কিন্তু রূঢ় না।” এই ভারসাম্যই প্রকৃত নেতৃত্বের পরিচয়।

৩. প্রশাসনিক ন্যায়পরায়ণতা

জনগণের কাজকে সত্য ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে পরিচালনা করার নির্দেশ ইমাম (আ.) দিয়েছেন। শুধু দায়িত্ব পালন নয়—নৈতিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই প্রকৃত শাসনের পরিচয়।

৪. দায়িত্বদাতার প্রতি বিশ্বস্ততা

কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং তাদের প্রতিনিধিদের প্রতি সম্মান ও সহযোগিতা বজায় রাখতে ইমাম (আ.) গুরুত্ব দিয়েছেন, যাতে শাসনযন্ত্রের সামগ্রিক স্থিতি বজায় থাকে।

চোগলখোরদের থেকে দূরে থাকো— তারা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিপদ

ইমাম (আ.)-এর চিঠির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে রাষ্ট্রপরিচালনার অদৃশ্য কিন্তু ভয়াবহ শত্রুর পরিচয়: চোগলখোর ও ফিতনা–সৃষ্টিকারী মানুষ।

“একজনও যেন তোমার আশপাশে না আসে। তাদের তওবা গ্রহণ কোরো না; তারা আল্লাহর রোষ ডেকে আনে এবং তোমার আচ্ছাদিত রহস্য উদ্‌ঘাটিত করবে।”

ইতিহাস সাক্ষী—অধিকাংশ অত্যাচার, দুর্নীতি এবং রক্তপাতের সূচনা হয় এদের মাধ্যমে।

কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে?

ইমাম (আ.) নির্দেশ দেন:

  • অভিজ্ঞ

  • বুদ্ধিমান

  • বিশ্বস্ত

  • এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে সমমনা

এমন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়তে হবে। কারণ নেতৃত্ব কখনো একক যাত্রা নয়; এটি ঠিক সঙ্গী বাছাইয়ের শিল্প।

অর্থ সঞ্চয়ের বদলে দরিদ্রের অভিভাবক হও

ইমাম (আ.) সতর্ক করেন—“সোনা–রূপা জমা কোরো না, নতুবা সেই লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা সোনা–রূপা জমা করে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে না—তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ।’

তিনি আরও বলেন—খাবারের সামান্য অংশ, কিছু মিষ্টি কিংবা পুরোনো কাপড় হলেও ক্ষুধার্তদের দান করো। কারণ— “এগুলো আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে।”

প্রতিবেশীর ক্ষুধা—ঈমানের পরিমাপ

ইমাম (আ.) তাঁর পূর্বপুরুষদের সূত্রে আমিরুল মু’মিনীন (আ.) এবং সেখান থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এক বাণী তুলে ধরেন, “সে ঈমানদার নয়—যে নিজে পেট ভরে রাত কাটায়, অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।”

সাহাবারা আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলে নবী (সা.) বলেন— “তোমাদের খাবারের অবশিষ্টাংশ, খেজুর, পুরোনো কাপড়—যা পারো দান করো। এগুলো আল্লাহর রোষ নিবারণ করে।”

এ এক অবিস্মরণীয় মানবিক নীতি—ইবাদত কেবল মসজিদে নয়; সমাজের ক্ষুধার্ত মানুষকে অন্ন দেয়াও ইবাদত!

মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অনন্ত দিশা

ইমাম সাদিক (আ.)-এর এই চিঠি শুধু একটি ব্যক্তিগত উপদেশ নয়; এটি ন্যায়ভিত্তিক নেতৃত্ব, জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং নৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এক অনন্ত দলিল। আয়াতুল্লাহ শুবেইরী জান্জানীর ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই চিঠি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—

  • ক্ষমতা মূলত একটি নৈতিক পরীক্ষা,

  • নেতৃত্ব মানে সেবা,

  • এবং প্রকৃত শাসন হলো মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ার শিল্প।

ইসলামী রাজনীতি হোক বা সাধারণ মানবিক নীতি—এই চিঠি আজও পথ দেখায়।

 আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button