জীবনযাপনধর্ম ও বিশ্বাসবিশেষ সংবাদবিশ্ব

হারাম উপার্জনের প্রভাব—আদমসন্তানের পথভ্রষ্টতায়

ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন। প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫

মিডিয়া মিহির: ইসলামী দৃষ্টিতে মানুষের চরিত্র, বিশ্বাস এবং পরবর্তী প্রজন্মের নৈতিক গঠন গভীরভাবে প্রভাবিত হয় তার উপার্জনের প্রকৃতি দ্বারা। হারাম উপার্জন শুধু ব্যক্তিকে নয়, তার বংশধরকেও পথভ্রষ্ট করতে পারে—এমনটি কোরআন, হাদিস ও ইমামদের শিক্ষায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এই লেখায় শয়তানের বহুমুখী প্রতারণা, বিশেষত “সম্পদে অংশীদারিত্ব”—অর্থাৎ রিজিককে অপবিত্র ও হারাম করার কৌশল—কীভাবে আদমের বংশধরকে বিপথে ঠেলে দেয় তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ইবলিস মানুষকে বিভ্রান্ত করতে কোনো একক দরজা বেছে নেয় না। সে মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে নানা পথ ধরে—মধ্যরাত্রির ফিসফিসানি, লোভের মায়া, কিংবা সম্পদে তার অনিষ্টকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে; যেখানে হালাল রিজিকের সরল পথ থেকে এক সামান্য বিচ্যুতিও মানুষকে দূর ভবিষ্যতের অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দেয়।

হালাল উপার্জনের প্রতি যত্ন এবং হারাম থেকে কঠোর দূরত্ব—ইসলামের নৈতিক শিক্ষার এক মহাসূত্র। যার অর্থনীতি পবিত্র, সেই সমাজই দুনিয়া ও পরকালে পূর্ণতা ও মঙ্গল স্পর্শ করে। কারণ মানুষ যে রুটি খায়, তা কেবল শরীরকে নয়—তার আত্মা, চিন্তা, হৃদয় ও বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ বা কলুষিত করে।

রিজিকের প্রভাব কত গভীর—তা বুঝতে ইমাম হুসাইন (আ.)–এর আশুরার ভাষণই যথেষ্ট। তিনি তাঁর শত্রুদের বলেছিলেন: «فَقَدْ مُلِئَتْ بُطُونُکُمْ مِنَ الْحَرَامِ…» অর্থ: তোমাদের অন্তরাত্মা হারামে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে; তাই তোমরা সত্য শুনতে প্রস্তুত নও।

এই কারণেই আল্লাহ তাআলা কোরআনের বহু আয়াতে রিজিকের শুদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। সূরা আবাসের আয়াত— «فَلْیَنْظُرِ الْإِنْسانُ إِلى‌ طَعامِهِ» অর্থ: মানুষ যেন গভীর দৃষ্টিতে দেখে সে কী গ্রহণ করছে। ইমাম বাকির (আ.) এর ব্যাখ্যায় বলেন—এখানে মানুষের খাদ্য বলতে তার জ্ঞানের উৎসও বোঝানো হয়েছে। কেননা জ্ঞানের প্রথম আলো বা অন্ধকার মানুষের হৃদয়েই প্রতিফলিত হয়; আর হৃদয়ই ঈমানের পবিত্র আসন।

তেমনি সূরা ইসরা, আয়াত ৬৪-এ আল্লাহ ইবলিসকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন:
«وَ اسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِکَ …» অর্থ: তোমার কণ্ঠের উত্তেজনায় যাদের পারো প্রলুব্ধ কর; তোমার অশ্বরোহী ও পদাতিকদের নিয়ে আক্রমণ চালাও; তাদের সম্পদ ও সন্তানদের ব্যাপারে তোমার অধিকার দাবি কর—কিন্তু মনে রেখো, তোমার প্রতিশ্রুতি প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এখানেই প্রকাশ পায় শয়তানের এক সূক্ষ্ম কৌশল—মানুষের সম্পদে অংশ নেওয়া, অর্থাৎ তার উপার্জনকে কলুষিত করা, যাতে এক মানুষ নয়—তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মও নৈতিক অন্ধকারে তলিয়ে যায়। হারামের এই ছায়া বংশের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়।

ইমাম সাদিক (আ.) এই সত্যকে এমনভাবে প্রকাশ করেন: «کَسبُ الحَرام یُبَیِّنُ فِی الذُّرِّیَةِ» অর্থ: হারাম উপার্জনের দাগ সন্তানের বুকে ফুটে ওঠে।

অতএব মানুষ কেবল নিজের জন্য নয়; তার বংশধরদের জন্যও দায়বদ্ধ। আত্মশুদ্ধিতে শৈথিল্য বা নৈতিক অবহেলা তার রক্তধারার পরবর্তী কুঁড়ির ওপরও গভীর ছাপ রেখে যায়। আর হারাম রিজিক এই অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান উৎস—যা আদমের বংশধরকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিপথে ঠেলে দেয়।

আরও পড়ুন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button